জাফর ওয়াজেদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার মামলা, ইমরান সরকারের বিদেশ যাত্রায় বাঁধা এবং কোটা আন্দোলন দমনের গণতন্ত্রের শেষ কোথায়
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৫৭:০০,অপরাহ্ন ২১ জুলাই ২০১৮ | সংবাদটি ৯৯০ বার পঠিত
সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে লেখার এ এক বিপদ। কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে লেখা হবে- এত ইস্যু । নতুন নতুন। একটা থেকে আরেকটার গুরুত্ব কম থাকে না। এসব ঘটনার তাৎক্ষণিক বলেন সুদূরপ্রসারী বলেন একটা প্রতিক্রিয়া আছে, একটার রেশ না যেতে আরেকটা আসে। পোড়া দেশে। ভয়াবহ আশংকায় ফেলে দেয়। মহাসড়কের দাবি হয়তো বেশি হতে পারে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অর্জনতো আছে। সরকারী বেসরকারী প্রচেষ্টায়, আমজনতার প্রাত্যহিক কর্মকান্ড কিংবা বিদেশে যে কোটির উপর প্রবাসী আছেন তাদের অবদানতো কম বেশি আছে। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধির হিসেব দেখিয়ে স্বপ্ন দেখান, পরিকল্পনা মন্ত্রী সিংগাপুর মালয়েশিয়া হতে কত বাকি তার কথা বলেন। কিন্তু সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ, বৈচিত্রে সৌকর্যে মানবিকতার টেকসই উন্নয়নে কতদূর আমাদের অর্জন সেটা নিয়ে কথা হয় খুব কম। ব্রীজ বিল্ডিং কংক্রীটের উন্নয়নের ধারণা থেকে উন্নত দেশগুলো সেই কবে সরে এসেছে। কে কিভাবে সবুজ পৃথিবী গড়বে, শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদনে কিভাবে নাগরিককে আরো সুযোগ সুবিধা দেয়া যাবে, বৃহৎ কর্পোরেশনের থাবা থেকে কিভাবে সাধারণ নাগরিকের অধিকার ও অর্জনের সুরক্ষা করবে, রাস্ট্রের খবরদারির চরিত্র বদলে কিভাবে তাকে শুধু নাগরিকের সব শুভ উদ্যোগে সহায়তাকারীর ভূমিকায় আনা যাবে তা নিয়ে সুশীল সমাজের চাপ, সরকারগুলোর নীতিনির্ধারণীতেও বিস্তর চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম চলছে।
সে যাক ফিরে যাই আমাদের আংগিনায়।
ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন । কালো আইন ৫৭ ধারায় একটি মামলা হয়েছে কুস্টিয়াতে। মামলায় প্রবীণ সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার বাদি কুস্টিয়ার এক সাংবাদিক নেতা। জাফর ওয়াজেদ, আমার মত অনেক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছে যিনি আমাদের জাফর ভাই এক সময় দৈনিক সংবাদে কাজ করতেন। পরে কিছু সময়ের জন্য লাল সবুজ হয়ে মুক্তকন্ঠ । বর্তমানে দৈনিক জনকন্ঠের সহকারী সম্পাদক। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, কলাম লেখক এবং যে ইউনিয়নের জেলা ইউনিট নেতা উনার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সেই ইউনিয়নেরও তিনি একজন নেতা। ছাত্র রাজনীতি করতেন । তাঁর দলের জন্য বৈরী সময়ে ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে তিনি দুবার ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। যতদূর জানা যায় মামলায় বলা হয়েছে, ১৩ জুলাই কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত বিএফইউজের নির্বাচন নিয়ে ১৫ জুলাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ। ‘মৃত ব্যক্তির ভোট দান’ শিরোনামে ওই পোস্টে তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ও সাংবাদিক ইউনিয়ন কুষ্টিয়ার সভাপতি ও বিএফইউজের নির্বাহী সদস্য রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব সম্পর্কে ‘মানহানি ও আপত্তিকর’ মন্তব্য করেন। এ কারণে মামলাটি করা হয়েছে। সাংবাদিক হয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কালো আইন ৫৭ ধারায় মামলা কেন এ ব্যাপারে মামলার বাদি ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি শুধু সাংবাদিক নন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। মামলা দেয়া হয়েছে ব্যক্তির নামে। এজন্য জাফর ওয়াজেদের নাম ও গ্রামের ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এদিকে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাংবাদিকের এই মামলাকে কার্যত সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন , ‘সাংবাদিকরা সচেতন নাগরিক। সচেতন হয়ে কেউ যদি আইন লঙ্ঘন করে এবং এর কারণে যদি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় এর দায়ভার কিন্তু সেই সাংবাদিক এড়াতে পারেন না। আইন লঙ্ঘন করার দায় তো তাকে নিতেই হবে ( সারাবাংলা.নেট ২০/০৭/২০১৮)’।
ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন- গতকাল সন্ধ্যায় গণজাগরণ মণচের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার আমেরিকা যাবার জন্য ইমিগ্রেশন চেক সহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিমানে নির্ধারিত আসনে বসেছিলেন। সেখান থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে নামিয়ে নিয়ে আসেন এবং বলা হয়েছে উপরের নির্দেশে তাকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। আমেরিকান সরকারের U.S. Department of State এর আমন্ত্রণে অহিংস আন্দোলন, লিডারশিপ, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে আজ ৪ সপ্তাহের জন্য আমার আমেরিকা যাবার কথা ছিল। ইমরান বলেছেন-যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কিংবা মামলা নেই, তবু তাকে বাঁধা দেয়া হয়েছে।
সংস্কারের দাবির মুখে সব ধরণের কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে তা থেকে পুরো ইউটার্ন নিয়েছেন সরকারপ্রধান। যে সংসদে দাড়িয়ে তিনি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে দাড়িয়েই তিনি বলেছেন- বিশেষত মুক্তিযোদ্ধার বংশধরদের বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় থাকায় তিনি তাতে হাত দিতে পারবেন। তাহলে আগে সংস্কারের দাবির মুখে পুরো বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরটাও এর পরদিন প্রধানমন্ত্রী সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন কোটা সংস্কার দাবি আন্দোলনের জন্য সৃষ্ট তাঁর ভাষায় ‘অরাজক পরিস্থিতি’তে তিনি কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য এটা ছিল তাঁর বিশেষ কৌশল। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ৩৮ টাকার খাওয়া আর মাসিক ১৫ টাকায় হলের সীট ভাড়ার কথা বলে এত লাফালাফির কারণ জানতে চেয়ে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন। সংসদে তিনি আরো স্পস্ট করে যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসায় হামলার সাথে জড়িত । তাদের কোনভাবেই ছাড়া হবে না। মেয়ে দের উপর নৃশংস হামলা, শিক্ষকদের ধাক্কা ধাক্কি সহ গায়ে হাত তুলে এবং হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাডগোড ভাংগার মত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিভৎস নির্যাতন এবং চিকিৎসা না দিয়ে গুরুতর আহত ছাত্রদের সরকারী হাসপাতাল থেকে বের করার ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নীরব থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকলেও এক কাঠি সরেশ তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক বাচ্চাদের মত করে বলেছেন- এখনতো ছাত্রলীগের কমিটি নেই তাই কারা এসব করছে তা খবর নিয়ে জানতে হবে। কথায় আছেনা আক্কেলমান ক্যা ইশারায় কাফি! স্বভাবতই কথা উঠেছে সংস্কারবাদীদের উপর নির্যাতন নিপীড়নের বিষয়ে সরকারপ্রধানের নীরবতা এবং তাঁর দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার শিশুসুলভ যুক্তি কি প্রকারান্তরে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অনুমোদন এবং সমর্থনের দিকটি পরিস্কার করে না??
হামলা মামলা দিয়ে সব প্রতিবাদ আন্দোলনকে স্তব্দ করে দেয়ার চেস্টা চলছে বলে সংগতকারণেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা লোকজন কোনরকম ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারছে না। দাবি দাওয়ার আন্দোলন কে নানা ট্যাগ দিয়ে দমনের অব্যাহত প্রচেষ্টা বলবৎ আছে এবং পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হচ্ছে তা দিনে দিনে বাড়ছে। অবস্থা এতই সংগীন যে জাফর ওয়াজেদের মত পরীক্ষিত দলীয় সমর্থক সিনিয়র সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও ৫৭ ধারার কালাকানুন দিয়ে মামলা হয় । মামলা দায়ের যিনি করেন তিনিও দলীয় লোক আর এর পক্ষে সাফাই গান প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রী মর্যাদার তথ্য উপদেষ্টা। এই তথ্য উপদেস্টাই এ মামলার মূল কারিগর বলে বলাবলি হচ্ছে। ইমরান এইচ সরকার এক সময় সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং একসময় কম বেশি সরকারের আনুকল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা তিনি পেয়েছেন এটা সর্বজনবিদিত। সেই তিনিও অপ্রিয় হয়ে গেলেন সরকারের কিছু অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে। আর সংস্কারের দাবি নিয়ে কোটা আন্দোলন কারীদের উপর হামলা এবং তাদের প্রতি অন্যায় নির্যাতনমূলক আচরণের প্রতিবাদে সংহতি প্রকাশকারী শিক্ষকদের উপর পুলিশ ওস্ট্রিট গ্রুপের হামলার পরও শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের নৈতিক ও ন্যায়সংগত অবস্থানের প্রতি টিকা টিপ্পনী কাটা হয়েছে!
সবমিলিয়ে বড় এক সংকটকাল অতিক্রম করছে দেশ। দিন দিন রাস্ট্র অধিকতর নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে চূড়ান্ত ভাবে যেন নির্বাসনের আয়োজন করছে। ফৌজি শাসন বা জরুরী অবস্থার সরকার থাকলে মানুষ হয়তো সান্ত্বনা পেত, কিন্তু সবই চলছে গণতন্ত্রের নামে আর অজুহাত আসছে তীর উপচানো উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই বিরোধীরা চেস্টা করছে। নানা গল্প আসছে। আর কত এমনটা চলবে ? চলতে পারে? বা প্রশ্নটা হতে পারে নাগরিকদেরও বা আর কত সহ্য করার ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে? নিবর্তন নিপীড়ন দিয়ে আর যাই হোক গণতন্ত্র হয় না!
শাহ আলম ফারুক : লন্ডনে নির্বাসিত
বাংলাদেশী মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী
সাবেক সিনিয়র তদন্ত কর্মকর্তা,
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
faruk69@gmail.com