ইব্রাহিম খলিল
চট্টগ্রামে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে অগ্নিকাণ্ড। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ দিনে ছয়টি এবং জানুয়ারি মাসেই ঘটেছে ৪৯টি আগুনের ঘটনা। এই হিসাবে ৩৬ দিনের ঘটেছে ৫৫টি অগ্নিকাণ্ড। এসব অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানিসহ পুড়ছে ঘর-বাড়ি, দালানকোটা ও মূল্যবান সম্পদ।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জে শুটকি পট্টি এবং আসকর দিঘীর পারে ৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার ভোরে মশার কয়েলের আগুনে নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে যাত্রীবাহী দুটি বাস পুড়ে গেছে। ৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার হালিশহরের ফইল্যাতলি বাজারে আগুনে পুড়েছে ১১টি সেমিপাকা দোকান ও ১৩টি কাঁচা বসতঘর। ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর পতেঙ্গায় ১৫টি দোকান পুড়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার নগরীর অক্সিজেন এলাকায় পুড়েছে একটি বস্তির শতাধিক ঘর।
এছাড়া, গত ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়ায় গ্যাস বিম্ফোরণে অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে মারা যান দাদি ছমুদা খাতুন (৭০) ও নাতনি তনিমা আফরিন ইফতি (১৫)। মৃত্যুর মুখোমুখি নাতি আরিফও (৩২), যা নগরবাসীকে নাড়া দেয়।
গত ২৮ জানুয়ারি শনিবার নগরীর পূর্ব বাকলিয়ায়, রবিবার পাহাড়তলি ও ডবলমুরিংয়ে আলাদা আগুন লাগার ঘটনায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে তিন কোটি টাকার মালামাল। ২৯ জানুয়ারি রবিবার চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকায় কাদের মার্কেটে আগুন লেগে তিনটি দোকান পুড়ে গেছে।
৩১ জানুয়ারি সোমবার রাতে নগরীর সদরঘাট থানাধীন মাইল্যার বিল বস্তিতে আগুনে পুড়েছে একটি মসজিদ, একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, ছয়টি কাঁচা ঘর, ১৪টি সেমিপাকা ঘর ও ছয়টি দোকান। প্রাথমিক হিসাবে এতে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এভাবে জানুয়ারি মাসে নগরীতে ৪৯টি আগুনের ঘটনায় মারা গেছে দুইজন। অগ্নিদ্বগ্ধ হয়েছেন চারজন। পুড়েছে প্রায় দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকার সম্পদ।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর চট্টগ্রাম জেলায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৫৯৮টি। প্রাণ হারিয়েছে ছয়জন। অগ্নিদ্বগ্ধ হয়েছেন ২৫ জন। আগুনে পুড়েছে ২৭ কোটি ৮৬ হাজার টাকার সম্পদ। আনুমানিক উদ্ধারকৃত সম্পদ ১২৬ কোটি ৮২ লাখ ১৮ হাজার টাকা।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগীয় দপ্তরের পরিদর্শক মামুন-উর-রশিদ জানান, চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত যত আগুনের ঘটনা ঘটেছে এর প্রধান কারণ ছিল বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গ্যাস বিস্ফোরণ, চুলার আগুন, জ্বলন্ত সিগারেট ও মশার কয়েলের টুকরো। এছাড়া গাড়ি বা কলকারখানার ইঞ্জিনের ঘর্ষণ, খোলা বাতি, অতিরিক্ত তাপ ইত্যাদি কারণেও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
এরমধ্যে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চুলার আগুনে ১৬১টি, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ২৪৯টি, সিগারেটের টুকরা ৯১টি, খোলা বাতির ব্যবহারে ২৪টি, উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি ১১টি, অজ্ঞাত কারণ ৪৯টি, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা দুটি, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণজনিত কারণে সাতটি, অগ্নি-সংযোগে ১১টি, মিস ফায়ারে তিনটি আগুনের ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক কামাল উদ্দিন বলেন, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ছুটে গেলেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর মূল কারণ হচ্ছে সরু রাস্তা। অনেক সময় আগুন নেভানোর জন্য আশপাশে পানির উৎসও পাওয়া যায় না।
কামাল উদ্দিন বলেন, লোকজনের অসতর্কতা, ছোট ছেলে-মেয়েদের আগুন নিয়ে খেলা ও যত্রতত্র বিড়ি সিগারেটের অবশিষ্টাংশ নিক্ষেপ না করা এবং বিল্ডিং কোড মেনে বহুতল ভবনগুলো তৈরি করা হলে এ সমস্যা অনেকাংশে কমে যেত।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তাফিজ আল মামুন বলেন, ৬০ ভাগ অগ্নিকাণ্ড হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। বিশেষ করে শক-সার্কিট ও আর্ক ব্লাসড বা লো-ভোল্টেজ থেকে হাই ভোল্টেজে বিদ্যুৎ উঠানামা করলে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া সার্কিট ব্রেকারেও বৈদ্যুতিক গোলযোগ হতে পারে। কারণ বাসায় বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়ার সময় যে লোড নেয়া হচ্ছে তার চেয়ে দ্বিগুণ লোডের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার হচ্ছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগের আরও বড় কারণ অরক্ষিত ফিটিংস। বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত কেবলের বিপরীতে নিম্নমানের কেবল ব্যবহার, বছর পর ওয়ারিং পরীক্ষা না করা, শিল্প কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কম এবং শ্রমিকদের অসচেতনার অভাবে আগুন বেশি লাগার ঘটনা চোখে পড়ে।