জাকিয়া আহমেদ
দেশে ক্যান্সার বিষয়ক চিকিৎসার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও ইনস্টিটিউট, কিন্তু অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অনিয়মের কারণে এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে হতাশ রোগীরা। যত্রতত্র ময়লার খোলা ড্রাম, বিকল পানি পরিশোধন যন্ত্র, টাকা না দিলে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল না পাওয়াসহ নানান অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছেন তারা।
রোগীরা জানান, হাসপাতালের বাথরুমগুলোতে যেতে হয় নাক চেপে। সিঁড়ির ওপরে পানের পিক, প্লাস্টিকের বোতল, কয়েকদিনের বাসি খাবার পড়ে থাকে এখানে-ওখানে, মেডিক্যাল বর্জ্যগুলো দিনের পর দিন পড়ে থাকলেও দেখার কেউ নেই! পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দৌরাত্ম্যে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না রোগী ও স্বজনরা।
শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মহাখালীতে ক্যান্সার জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ) সরেজমিনে দেখা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে বর্হিবিভাগে রোগী নেই আর চিকিৎসকের সংখ্যাও কম। রোগী এবং কয়েকজন সেবিকা জানালেন, ছুটির দিনগুলোতে কেবল জরুরি বিভাগে সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসক থাকেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হাসপাতালে আসেন না। আর ওয়ার্ডগুলোতে চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ খুব একটা চোখে পড়ে না কারও। খুব বেশি প্রয়োজন হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা রোগীদের দেখে যান বলে জানা গেছে।
ক্যানসার হাসপাতালের দেয়ালগুলো পানের পিকে নোংরা থাকে বছরের পর বছর ধরে
ক্যানসার হাসপাতালের দেয়ালগুলো পানের পিকে নোংরা থাকে বছরের পর বছর ধরে
হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটির খোলা জায়গায় রয়েছে ময়লা রাখার ডাস্টবিন। কিন্তু সেগুলো ঢাকনাবিহীন। এ কারণে গন্ধ ছড়াচ্ছে। ড্রামগুলোর ভেতরে মেডিকেল বর্জ্য, যেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে জীবাণু। তবে এ হাসপাতালেই চিকিৎসা নেওয়ায় কোনও রোগী বা আত্মীয়-স্বজন প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ক্যান্সার হাসপাতালের মতো এতো স্পর্শকাতর জায়গায় এভাবে ময়লার ড্রাম রাখায় হতবাক গোপালগঞ্জ থেকে ছেলেকে নিয়ে আসা এক মা। তিনি বলেন, ‘ফ্লোরে কিছু পড়ে গেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ডেকেও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে তাই নিজেরা ফ্লোর পরিষ্কার করি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ওয়ার্ডগুলোতে ঝাড়ু রেখে কোনও না কোনও বাহানায় চলে যায়। শেষে বাধ্য হয়ে আমরাই কেউ না কেউ ঝাড়ু দেই।’
তৃতীয় তলায় অবস্থিত আইসিইউর সামনের অংশে দেখা গেল, একটি পাপোশ রাখা আছে সামনে। কোনও আলো নেই। আদতে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডই অন্ধকার! আইসিইউতে থাকা স্বামীর জন্য গত চারদিন ধরে এখানে আছেন নার্গিস বেগম (ছদ্মনাম)। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এই অন্ধকারের ভেতরে আমরা বসে থাকি, মশা কামড়ায়, নাকে গন্ধ লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই।’ বাইরে সুইচ টিপে বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হতাশা নিয়ে তিনি বললেন, হাসপাতালে যদি আলো না থাকে তাহলে আমরা বসবো কোথায়? এখানে বসে থাকা যায় কীভাবে?’ নার্গিস বেগমের মন্তব্য—অব্যস্থাপনার এক উজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছে হাসপাতালটি!
এদিকে প্রতিটি ওয়ার্ডে পানি পরিশোধন যন্ত্র পড়ে আছে বিকল হয়ে। রোগীদের পানি খেতে হয় বাইরে থেকে কিনে এনে। হাসপাতালটির একজন ওয়ার্ড বয় বলেন, ‘কয়েক বছর আগে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য অন্তত দুটি করে এই পানি পরিশোধন যন্ত্র কেনা হয়েছিল। কিন্তু দেড় বছর আগে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এরপর মেরামতের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। হাসপাতালের রোগীসহ আমরাও এই পানি খেতাম। কিন্তু এখন সেই সুবিধা নেই। আমরা অনেক সময় নিজেদের ব্যবস্থায় পানি নিয়ে এলেও রোগীদের কষ্ট হয়।’
শুধু তাই নয়, হাসপাতালে টাকা না দিলে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল পাওয়া যায় না বলেও তাদেরই কয়েকজন স্বজনের অভিযোগ। হোসনে আরা বেগম (ছদ্মনাম) গত ছয়দিন ধরে এসেছেন স্বামীকে নিয়ে। বৃহস্পতিবার তার স্বামীর রক্ত পরীক্ষার তারিখ ছিল, কিন্তু এখানে সিরিয়াল না পাওয়ায় হাসপাতালের একজন খালা (আয়া) তাকে নিয়ে যান রাস্তার ওপারের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। সেখানে ৯০০ টাকা খরচ করে তিনি পরীক্ষা করিয়েছেন।
হোসনে আর বেগম বলেন, ‘জমি-জিরাত বিক্রি করে এতোদিন চিকিৎসা করাইছি। ১৪ দিন পরপর কেমোথেরাপি দিতে হয় স্বামীকে। কিন্তু গতকাল রক্ত পরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে হইছে। টাকা না দিলে এখানে রোগী দেখানো যায় না। পরীক্ষাগুলোই বাইরে থেকে করাতে হয়। তাইলে আর সরকারি হাসপাতালে এতো কষ্ট করে কী লাভ?’
হাসপাতালটির এহেন অব্যবস্থাপনার জন্য পরিচালককেই দায়ী করেছেন কয়েকজন চিকিৎসক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসকের ভাষ্য, ‘বর্তমানে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন। যার মধ্যে কোনও নেতৃত্বের গুণাবলী নেই। তিনি অর্থব একজন মানুষ! বরাবরই নিজের চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষদের কথায় কান দেন তিনি। তাদের কথা ছাড়া কোনও ফাইল স্বাক্ষর করেন না!’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন চিকিৎসক বলেন, ‘হাসপাতালের কেমোথেরাপির ওষুধ বাইরে চলে যাচ্ছে, রেডিওথেরাপির ছয়টি মেশিনের কয়েকটি মাঝে মধ্যেই নষ্ট থাকে। যেটা আগে ছিল না। এটাও প্রশাসনের ব্যর্থতা।’ এখানে প্রশাসন ধসেই পড়েছে বলে মনে করেন একজন চিকিৎসক।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, এ মুহুর্তে তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন।