স্টাফ রিপোর্টার,
আমাদের হত্যা করবেন না, আমরা আপনাদের ভবিষ্যৎ। এ আকুতি জানিয়ে রাজপথে নেমেছে খুলনার শিশুরা। শিশু রাকিব হত্যা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর ও খুনিদের বিচার দাবিতে শিশুরা গতকাল বৃহস্পতিবার খুলনা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিকে মামলায় গ্রেপ্তারকৃত বিউটি বেগমকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। এ হত্যা মামলার প্রতক্ষ্যদর্শী সাক্ষী নয় বছরের শিশু নাবিল হাসান ফাহিম আদালতে লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। রাকিব হত্যার বিচার দাবিতে নগরীতে সমাবেশ বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
খুলনায় আলোচিত শিশু রাকিব হত্যার প্রতিবাদে খুলনার শিশুরা তিন দিনের কর্মসূচি শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শিশু রবিউল ও নিশাত আরা। কর্মসূচির প্রথম দিনে গতকাল বিকাল ৪টায় খুলনা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। এছাড়া আজ ৭ই আগস্ট সকাল ১০টায় শিশুদের কালো ব্যাজ ধারণ ও ডাকবাংলো মোড়ে মানববন্ধন। সংবাদ সম্মেলনে রাকিব হত্যার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর ও হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করা হয়।
অপরদিকে পৈশাচিক নির্যাতনে নিহত শিশু রাকিব হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে তৃতীয় দিনের মতো উত্তাল ছিল খুলনা মহানগরী। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ, মিছিল, মানববন্ধন হয়েছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে ওঠে গোটা নগরী। সকাল ১০টায় নগরীর পিটিআই মোড়ে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে মানববন্ধন করে। সকাল সাড়ে ১০টায় রাকিবের এলাকাবাসী টুটপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে অবস্থান নেয়। পরে মিছিলটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এতে অংশ নেন নিহত শিশু রাকিবের খালা পারুল বেগম, একমাত্র ছোট বোন রিমিসহ সর্বস্তরের জনতা।
বিউটি বেগম রিমান্ডে: পৈশাচিক নির্যাতনে নিহত শিশু শ্রমিক রাকিব হত্যা মামলার প্রধান আসামি মোটরসাইকেল গ্যারেজ মালিক ওমর শরীফের মা বিউটি বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় খুলনা মহানগর হাকিম মো. ফারুক ইকবালের আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ফাহিমের লোমহর্ষক বর্ণনা: শিশু রাকিবকে পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনার বিবরণ আদালতে দিলো প্রত্যক্ষদর্শী আরেক শিশু নগরীর শঙ্খ মার্কেটস্থ ওসমান (রা.) তাফহিমুল কুরআন মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র নাবিল হাসান ফাহিম (৯)। বুধবার মহানগর হাকিম মো. ফারুক ইকবাল জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেন ফাহিমের দেয়া বক্তব্য।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দি প্রদানকারী টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা নাসির শেখের ছেলে শিশু নাবিল হাসান ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিল। সে আদালতে তার জবানবন্দিতে ঘটনার বিবরণে বলে, রাকিব রঙ কিনতে টুটপাড়া কবরখানা মোড়ে আসে। এ সময় তেলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিন্টু খান হাত ধরে টেনে রাকিবকে পাশের শরীফ মটরসের ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর মিন্টু ও শরীফ দুজনে মিলে শিশু রাকিবের জিন্সের প্যান্ট টেনে খুলে নেয়। এ সময় শরীফের মা বিউটি বেগম ঘটনাস্থলে ছিলেন। রাকিবের প্যান্ট খুলে তার মলদ্বারে গাড়িতে হাওয়া দেয়া মেশিনের পাইপ ঢুকানোর চেষ্টা করতে থাকে। রাকিব চিৎকার করে বলতে থাকে ‘ও মামা ও মামা’ আমার পেটে ব্যথা করে, আমারে ছাইরা দেন। কিন্তু রাকিবকে তারা না ছেড়ে মলদ্বারে হাওয়া মেশিনের পাইপ ঢুকিয়ে তা চালু করে। পরে রাকিব চিৎকার করলে তারা গ্যারেজের সাটার টেনে দেয়।
চলতি মাসেই চার্জশিট: চাঞ্চল্যকর শিশু রাকিব হত্যা মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করে চার্জশিট চলতি আগস্ট মাসেই প্রদান করা হবে। পাশাপাশি চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হবে। ফলে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বুধবার রাতে খুলনা সদর থানায় মামলার অগ্রগতি পর্যালোচনা শেষে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝি এ কথা বলেন। এর আগে পুলিশ কমিশনার খুলনা সদর থানায় গিয়ে শিশু রাকিব হত্যা মামলার সার্বিক বিষয়ে নিবিড় পর্যালোচনা করেন এবং মানবিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি দ্রুত তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেন। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে চার্জশিট দাখিল করা হবে বলে আশা করছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, মামলার তদন্তে কোন প্রকার কালক্ষেপণ বা গাফিলতি বরদাশত করা হবে না বলে নির্দেশ প্রদান করেন পুলিশ কমিশনার। এ সময় মামলা পর্যালোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন শিশু রাকিব হত্যা মামলার বিষয়ে গঠিত মনিটরিং টিমের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব হাকিম, খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই কাজী মোস্তাক আহমেদ।
সমঝোতার প্রস্তাব দেয়ায় ভুয়া সাংবাদিককে গণধোলাই: নির্মমভাবে হত্যার শিকার শিশু রাকিবের বাবাকে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়ায় আলী হোসেন নামের এক ভুয়া সাংবাদিককে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়েছে। সে অপরাধ বিচিত্রা নামে একটি পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিতে রাকিবের বাবা নূর আলমের কাছ থেকে জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করানোর চেষ্টা চালায়।
খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস জানান, রাত সোয়া ৮টার দিকে টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডে রাকিবের বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে চায়। একপর্যায়ে সে মামলা চালিয়ে কি হবে, এর চেয়ে সমঝোতা করাই ভাল এসব কথা বলে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করে। এতে নূর আলম ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয়দের ডাক দিলে তারা আলী হোসেনকে ধরে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে মেডিক্যালের প্রিজন সেলে ভর্তি করে।
ঘাতক শরীফের ভাই আরিফ ও মিন্টুর ভাই বাবুও লাপাত্তা: নগরীর টুটপাড়া কবরখানা মোড়ের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতো রাকিব হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত শরীফ, তার মা বিউটি বেগম ও ছোট ভাই বাবু। রাকিবের মৃত্যুর পর গণপিটুনি দিয়ে শরীফ ও সহযোগী মিন্টু খানকে পুলিশে সোপর্দ করেছিল স্থানীয়রা। পরে শরীফের মা বিউটি বেগমকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার রাতেই বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শরীফদের বাসার সামনের সড়কে অগ্নিসংযোগ করেছিল। সেই থেকে গৃহশূন্য। শরীফের গ্যারেজের পাশে ছিল তার ছোট ভাই বাবুর চায়ের দোকান। ঘটনার পর থেকে বাবুও লাপাত্তা রয়েছে। মিন্টু খানের বাসায়ও গত বুধবার গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে শরীফের বড় ভাই আরিফ চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় আসেন। সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে গা ঢাকা দিয়েছে।