ঢাকা ০৯:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫, ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
প্রবাসে স্বৈরাচারের দোসরদের আস্ফালন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারের দাবি নাসিম আহমদ চৌধুরীর বিজয়নগরে স্কুল শিক্ষিকাকে বেধড়ক পিটিয়ে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার লুটপাট “লন্ডনে ‘প্রবাসীদের ক্ষমতায়ন: অধিকার, স্বীকৃতি ও জাতি গঠন – একটি এনআরবি প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক সেমিনার ও ইফতার মাহফিল অনুষ্টিত বিশ্বনাথে শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, যুবক গ্রেপ্তার সুনামগঞ্জে চলন্ত সিএনজিতে কিশোরীকে ধর্ষণচেষ্টা, আটক ২ ‘মানুষের উন্নয়নে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বারবার রক্ষা করেছেন খালেদা জিয়া’ জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকঃ দ্রুত নির্বাচনের দাবি বিএনপির “যুক্তরাজ্য যুবদলের সভাপতি আফজাল হোসেনকে ইলিয়াস পত্নী তাহসিনা রুশদির লুনার অভিনন্দন” বায়ান্নের ভাষা শহীদদের প্রতি নর্থইষ্ট বিএনপির শ্রদ্ধা নিবেদন প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে জয় লাভ করেন সোয়াবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালিকারা

বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্টের গল্প ইতিহাস

Papiya Devi Ashru
Contributor

“গরিব হল তারা, যাদের সব কিছু খুব বেশি বেশি দরকার। কারণ, যাদের সবকিছু খুব বেশি বেশি লাগে, তারা কখনোই জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট হয় না। আই অ্যাম ফ্রুগাল, নট পুয়োর। আমি একজন মিতব্যয়ী, আলোকিত স্যুটকেসের মতই আমি একজন মিতব্যয়ী। যতটুকু না হলেই জীবন চলে না, ঠিক ততটুকু নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। বিলাসী জীবনযাপন আমার একদমই পছন্দ না। আমার সাধারণ জীবনযাপনের সুবিধা হল, আমি কাজ করার জন্য প্রচুর সময় পাই। আমি যা যা পছন্দ করি, নিজে নিজেই তার সবকিছু করতে পারি। আমি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চাই আর আমি সেভাবেই বেঁচে আছি। লিভিং ফ্রুগালি ইজ এ ফিলোসফি অব লাইফ, বাট আই অ্যাম নট পুয়োর।” -হোসে মুহিকা ( উরুগুয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট)।

এই একটি উক্তি থেকেই বোঝা যে কতটা অসামান্য তার ধ্যান ধারণা, চিন্তা ভাবনা। প্রচলিত পুঁজিবাদি রাষ্ট্র পরিচালনার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে তার ভূমিকা অনন্য।

কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট অর্থ আমরা বুঝি খুব ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ, অর্থ-সম্পদে প্রাচুর্যপূর্ণ এবং মান আর যশে পরিপূর্ণ। পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শব্দটি সব সময় চিরাচরিত নিয়মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসে। তেমনি এক ব্যতিক্রমের জলজ্যান্ত উদাহরণ হোসে মুহিকা। উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকাকে পৃথিবীর সব চাইতে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট বলা হলেও মেধা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর ফিলোসফি জানার পর বোঝা যাবে তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩৫ সালের ২০ মে হোসে মুহিকা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দিমিত্রিও মুহিকা ছিলেন একজন কৃষক। আর মা লুসি করডানো একজন ইতালিয় মাইগ্র্যান্ট। মুহিকার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য। এই সময় তিনি স্থানীয় এক বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন। আবার কখনো কখনো হোটেল বয় হিসেবেও কাজ করেন। এসবের পাশাপাশি তিনি লিলি ফুল তুলে বিক্রি করেও সংসারের খরচ জোগান। এভাবেই দারিদ্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তার জীবন।

নিজের খামারে কর্মমুখর ব্যস্ত জীবনে হোসে মুহিকা
১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সে মুহিকা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে সাইকেল চালিয়ে অনেক পুরস্কার জেতেন। কিউবান বিপ্লবের প্রতি সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৬০ সালে উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে টুপামারোস গেরিলা মুভমেন্টে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে মন্টেভিডিওর কাছে পান্ডো শহরের দখল নিতে তিনি সফল গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। পরে উরুগুয়ের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ পাসেকো আরেকো’র সাংবিধানিক বিধি নিষেধের আওতায় তার জেল হয়। ১৯৭১ সালে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে পুন্টা ক্যারেটাস জেলখানা থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ১৯৭২ সালে তিনি আবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে আর্মি জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

তিনি ২০০৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় তিনি যতটা না আলোচিত হয়েছিলেন, তার জীবনযাপনের ধরণ তাকে বিশ্ব মিডিয়ায় তার চেয়েও বেশি আলোচনায় নিয়ে আসে। তবে বিশ্বের মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার মাসিক বেতন প্রায় ১২ হাজার ডলার। কিন্তু বেতনের শতকরা ৯০ ভাগই তিনি দান করে দেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এবং নিজের জন্য অবশিষ্ট রাখেন মাত্র ৭৭৫ ডলার (কমবেশি)। এই দানশীলতার কারণেই তাকে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। তার স্ত্রীর নাম লুসিয়াও। নিঃসন্তান এই দম্পতির সবচেয়ে দামি সম্পত্তি হলো ১৯৮৭ সালে কেনা এক হাজার ৮০০ ডলারের একটি গাড়ি।

হোসে মুহিকা বসবাস করেন তার খামার বাড়িতে। দুইজন পুলিশ আর তার তিন’পা ওয়ালা কুকুর মানুয়েলা থাকে বাড়ির নিরাপত্তায়। মুহিকার বাড়িটি রাজধানী মন্টেভিডিওর বাইরের এক পাহাড়ি কৃষি জনপদে। সেখানে তিনি ও তার স্ত্রী মিলে ফুলের চাষ করেন। পরিবার চলে স্ত্রীর আয় থেকে।

উরুগুয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এই ব্যক্তির বসবাসের খামার বাড়িটি দেখলে যে কেউ ভূতের বাড়ি বলে ভুল করতে পারে। বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকার বদলে তিনি বেছে নিয়েছেন নিতান্তই এক সাধারণ জীবন। এখনো কর্দমাক্ত পথ পেরিয়েই নিজের খামার বাড়িতে পৌঁছাতে হয় তাকে। এই অর্ধ-পরিত্যক্ত খামার বাড়ির মালিক তিনি নন, তার স্ত্রী। প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও খামারে স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত কৃষিকাজ করেন তিনি।

বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এই প্রেসিডেন্টের নিজেকে সব সময় ঋণমুক্ত রেখেছেন, আর তাই এক সময়কার বামপন্থি গেরিলা নেতা হোসে মুহিকার নামে কোনো ঋণ নেই, এমনকি নেই তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও। এমনকি নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। মাথাভরা এলোমেলো ধূসর চুল, ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, কাঁচাপাকা পুরু গোঁফজোড়া, দশাসই চেহারা দেখে বয়সটা অনুমান করা মুশকিল। দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবনযাপনের ধারা বদলাতে রাজি হন নি তিনি। সেই কারণেই বিলাসবহুল আড়ম্বর ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়ি-গাড়ি-খামার নিয়েই দিব্যি ভালোই আছেন মুহিকা, দেশবাসী যাকে আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’। ২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে।

প্রতিবছর উরুগুয়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ বাধ্যতামূলক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা তার সম্পদের পরিমাণ দেখান এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। যা কিনা তার ১৯৮৭ মডেলের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়িটির দাম। ২০১২ সালের বিবরণীতে স্ত্রীর অর্ধেক সম্পদ যুক্ত করেছেন। এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে জমি, ট্রাক্টর ও বাড়ির দাম। এতে তার মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ডলার, যা এখনো দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্টের ঘোষিত সম্পদের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ। মুহিকার অন্যতম সম্পদ বিটল কার। তবে সেটিও বোধহয় আর থাকবে না প্রেসিডেন্টের কাছে। ওই কারের জন্য ১০ লাখ ডলারের অফার পেয়েছেন তিনি। আর সহাস্যে তিনি তা বেচেও দিতে চান।

হোসে মুহিকার একমাত্র সম্পদ – ১৯৮৭ ভি ডব্লিউ বিটল
বাসকোয়েডা ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, কারটি বিক্রি করলে ১০ লাখ ডলার পাবেন তিনি। এক আরব শেখ তাকে এ অফার দিয়েছেন। হোসে মুহিকা এও বলেছেন, তিনি অফারটি গ্রহণ করবেন কিনা ভাবছেন। আর যদি সত্যিই তিনি কারটি বিক্রি করেন তাহলে প্রাপ্ত টাকা তিনি গরিবদের সাহায্যে বিলিয়ে দেবেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, গাড়ির সঙ্গে তার এমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই যে তা বিক্রি করা যাবে না। বরং হাসি মুখেই তিনি গাড়িটি বিক্রি করতে চান। আর সেই টাকা বিলিয়ে দিতে চান আশ্রয়হীনদের জন্য, যেন তারা মাথা গোঁজার ঠাঁই পান। অবশ্য মজা করে মুহিকা বলেন, গাড়িটি তিনি তার প্রিয় কুকুর ম্যানুলার জন্য রেখে দিতে চেয়েছিলেন।

পাঁচ বছর উরুগুয়ের সার্বিক উন্নতিতে অবদান রাখার পর তিনি যখন অফিস ত্যাগ করছেন তখন বলা হয়েছিল “পৃথিবীর সব চাইতে বিনীত লোকটি আজ পদত্যাগ করলেন”- এ ছিল হোসে মুহিকার জীবনের চরম চাওয়া এবং পাওয়া।

তথ্যসূত্র

https://en.wikipedia.org/wiki/Jos%C3%A9_Mujica
https://www.indy100.com/article/8-reasons-why-well-miss-jose-mujica-uruguays-maverick-president–e1t_MupEpl
http://www.bbc.com/news/magazine-20243493

10 Reasons to Love Uruguay’s President José Mujica

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রবাসে স্বৈরাচারের দোসরদের আস্ফালন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারের দাবি নাসিম আহমদ চৌধুরীর

বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্টের গল্প ইতিহাস

আপডেট সময় : ০৬:৪০:৩৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী ২০১৭

Papiya Devi Ashru
Contributor

“গরিব হল তারা, যাদের সব কিছু খুব বেশি বেশি দরকার। কারণ, যাদের সবকিছু খুব বেশি বেশি লাগে, তারা কখনোই জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট হয় না। আই অ্যাম ফ্রুগাল, নট পুয়োর। আমি একজন মিতব্যয়ী, আলোকিত স্যুটকেসের মতই আমি একজন মিতব্যয়ী। যতটুকু না হলেই জীবন চলে না, ঠিক ততটুকু নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। বিলাসী জীবনযাপন আমার একদমই পছন্দ না। আমার সাধারণ জীবনযাপনের সুবিধা হল, আমি কাজ করার জন্য প্রচুর সময় পাই। আমি যা যা পছন্দ করি, নিজে নিজেই তার সবকিছু করতে পারি। আমি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চাই আর আমি সেভাবেই বেঁচে আছি। লিভিং ফ্রুগালি ইজ এ ফিলোসফি অব লাইফ, বাট আই অ্যাম নট পুয়োর।” -হোসে মুহিকা ( উরুগুয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট)।

এই একটি উক্তি থেকেই বোঝা যে কতটা অসামান্য তার ধ্যান ধারণা, চিন্তা ভাবনা। প্রচলিত পুঁজিবাদি রাষ্ট্র পরিচালনার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে তার ভূমিকা অনন্য।

কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট অর্থ আমরা বুঝি খুব ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ, অর্থ-সম্পদে প্রাচুর্যপূর্ণ এবং মান আর যশে পরিপূর্ণ। পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শব্দটি সব সময় চিরাচরিত নিয়মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসে। তেমনি এক ব্যতিক্রমের জলজ্যান্ত উদাহরণ হোসে মুহিকা। উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকাকে পৃথিবীর সব চাইতে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট বলা হলেও মেধা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর ফিলোসফি জানার পর বোঝা যাবে তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩৫ সালের ২০ মে হোসে মুহিকা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দিমিত্রিও মুহিকা ছিলেন একজন কৃষক। আর মা লুসি করডানো একজন ইতালিয় মাইগ্র্যান্ট। মুহিকার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য। এই সময় তিনি স্থানীয় এক বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন। আবার কখনো কখনো হোটেল বয় হিসেবেও কাজ করেন। এসবের পাশাপাশি তিনি লিলি ফুল তুলে বিক্রি করেও সংসারের খরচ জোগান। এভাবেই দারিদ্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তার জীবন।

নিজের খামারে কর্মমুখর ব্যস্ত জীবনে হোসে মুহিকা
১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সে মুহিকা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে সাইকেল চালিয়ে অনেক পুরস্কার জেতেন। কিউবান বিপ্লবের প্রতি সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৬০ সালে উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে টুপামারোস গেরিলা মুভমেন্টে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে মন্টেভিডিওর কাছে পান্ডো শহরের দখল নিতে তিনি সফল গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। পরে উরুগুয়ের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ পাসেকো আরেকো’র সাংবিধানিক বিধি নিষেধের আওতায় তার জেল হয়। ১৯৭১ সালে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে পুন্টা ক্যারেটাস জেলখানা থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ১৯৭২ সালে তিনি আবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে আর্মি জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

তিনি ২০০৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় তিনি যতটা না আলোচিত হয়েছিলেন, তার জীবনযাপনের ধরণ তাকে বিশ্ব মিডিয়ায় তার চেয়েও বেশি আলোচনায় নিয়ে আসে। তবে বিশ্বের মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার মাসিক বেতন প্রায় ১২ হাজার ডলার। কিন্তু বেতনের শতকরা ৯০ ভাগই তিনি দান করে দেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এবং নিজের জন্য অবশিষ্ট রাখেন মাত্র ৭৭৫ ডলার (কমবেশি)। এই দানশীলতার কারণেই তাকে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। তার স্ত্রীর নাম লুসিয়াও। নিঃসন্তান এই দম্পতির সবচেয়ে দামি সম্পত্তি হলো ১৯৮৭ সালে কেনা এক হাজার ৮০০ ডলারের একটি গাড়ি।

হোসে মুহিকা বসবাস করেন তার খামার বাড়িতে। দুইজন পুলিশ আর তার তিন’পা ওয়ালা কুকুর মানুয়েলা থাকে বাড়ির নিরাপত্তায়। মুহিকার বাড়িটি রাজধানী মন্টেভিডিওর বাইরের এক পাহাড়ি কৃষি জনপদে। সেখানে তিনি ও তার স্ত্রী মিলে ফুলের চাষ করেন। পরিবার চলে স্ত্রীর আয় থেকে।

উরুগুয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এই ব্যক্তির বসবাসের খামার বাড়িটি দেখলে যে কেউ ভূতের বাড়ি বলে ভুল করতে পারে। বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকার বদলে তিনি বেছে নিয়েছেন নিতান্তই এক সাধারণ জীবন। এখনো কর্দমাক্ত পথ পেরিয়েই নিজের খামার বাড়িতে পৌঁছাতে হয় তাকে। এই অর্ধ-পরিত্যক্ত খামার বাড়ির মালিক তিনি নন, তার স্ত্রী। প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও খামারে স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত কৃষিকাজ করেন তিনি।

বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এই প্রেসিডেন্টের নিজেকে সব সময় ঋণমুক্ত রেখেছেন, আর তাই এক সময়কার বামপন্থি গেরিলা নেতা হোসে মুহিকার নামে কোনো ঋণ নেই, এমনকি নেই তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও। এমনকি নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। মাথাভরা এলোমেলো ধূসর চুল, ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, কাঁচাপাকা পুরু গোঁফজোড়া, দশাসই চেহারা দেখে বয়সটা অনুমান করা মুশকিল। দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবনযাপনের ধারা বদলাতে রাজি হন নি তিনি। সেই কারণেই বিলাসবহুল আড়ম্বর ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়ি-গাড়ি-খামার নিয়েই দিব্যি ভালোই আছেন মুহিকা, দেশবাসী যাকে আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’। ২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে।

প্রতিবছর উরুগুয়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ বাধ্যতামূলক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা তার সম্পদের পরিমাণ দেখান এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। যা কিনা তার ১৯৮৭ মডেলের ভক্সওয়াগন বিটল গাড়িটির দাম। ২০১২ সালের বিবরণীতে স্ত্রীর অর্ধেক সম্পদ যুক্ত করেছেন। এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে জমি, ট্রাক্টর ও বাড়ির দাম। এতে তার মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ডলার, যা এখনো দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্টের ঘোষিত সম্পদের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ। মুহিকার অন্যতম সম্পদ বিটল কার। তবে সেটিও বোধহয় আর থাকবে না প্রেসিডেন্টের কাছে। ওই কারের জন্য ১০ লাখ ডলারের অফার পেয়েছেন তিনি। আর সহাস্যে তিনি তা বেচেও দিতে চান।

হোসে মুহিকার একমাত্র সম্পদ – ১৯৮৭ ভি ডব্লিউ বিটল
বাসকোয়েডা ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, কারটি বিক্রি করলে ১০ লাখ ডলার পাবেন তিনি। এক আরব শেখ তাকে এ অফার দিয়েছেন। হোসে মুহিকা এও বলেছেন, তিনি অফারটি গ্রহণ করবেন কিনা ভাবছেন। আর যদি সত্যিই তিনি কারটি বিক্রি করেন তাহলে প্রাপ্ত টাকা তিনি গরিবদের সাহায্যে বিলিয়ে দেবেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, গাড়ির সঙ্গে তার এমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই যে তা বিক্রি করা যাবে না। বরং হাসি মুখেই তিনি গাড়িটি বিক্রি করতে চান। আর সেই টাকা বিলিয়ে দিতে চান আশ্রয়হীনদের জন্য, যেন তারা মাথা গোঁজার ঠাঁই পান। অবশ্য মজা করে মুহিকা বলেন, গাড়িটি তিনি তার প্রিয় কুকুর ম্যানুলার জন্য রেখে দিতে চেয়েছিলেন।

পাঁচ বছর উরুগুয়ের সার্বিক উন্নতিতে অবদান রাখার পর তিনি যখন অফিস ত্যাগ করছেন তখন বলা হয়েছিল “পৃথিবীর সব চাইতে বিনীত লোকটি আজ পদত্যাগ করলেন”- এ ছিল হোসে মুহিকার জীবনের চরম চাওয়া এবং পাওয়া।

তথ্যসূত্র

https://en.wikipedia.org/wiki/Jos%C3%A9_Mujica
https://www.indy100.com/article/8-reasons-why-well-miss-jose-mujica-uruguays-maverick-president–e1t_MupEpl
http://www.bbc.com/news/magazine-20243493

10 Reasons to Love Uruguay’s President José Mujica