গাজীপুর: বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আম বয়ানের মাধ্যমে টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদীর তীরে শুরু হচ্ছে।
দ্বিতীয় দফায়ও বহাল রয়েছে আগের দফার সব প্রস্তুতি। প্রথম পর্বের পর চারদিন বিরতি দিয়ে শুরু হচ্ছে ইজতেমার এ দ্বিতীয় পর্ব।
তবে বৃহস্পতিবার মাগরিব নামাজে পর ময়দানের ছামিয়ানার নিচে জমায়েত হওয়া মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে অনানুষ্ঠানিক বয়ান শুরু হয়েছে।
রোববার জোহরের নামাজের আগে (পূর্বাহ্নে) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এ বছরের ইজতেমা শেষ হবে।
দ্বিতীয় পর্বেও ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকা জেলার একাংশ এবং ১৬টি জেলার মুসল্লিদের ইজতেমা স্থলে আসা অব্যাহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে ইজতেমা মুখি মানুষের ঢল নামে টঙ্গীর দিকে। বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে মুসল্লিরা যোগ দিচ্ছেন ইজতেমায়।
এবার ১৭টি জেলার মুসল্লিদের জন্য ইজতেমার পুরো ময়দানকে ২৬টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। আগামী ২২ জানুয়ারি (রবিবার) দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে ৫২তম বিশ্ব ইজতেমা।
শুক্রবার ইজতেমা শুরু হওয়ায় দেশের সর্ব বৃহৎ জু’মার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমা ময়দানে। গাজীপুর, ঢাকার উত্তরা ও আশপাশের এলাকা থেকে লাখ লাখ মুসল্লি যোগ দেবেন এই জু’মার নামাজে।
ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, দ্বিতীয় পর্বের এজতেমায় যোগ দিতে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মুসল্লি ইজতেমা মাঠে সমবেত হয়েছেন। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসুল্লিদের এ আগমন অব্যাহত থাকবে। তারা নিজ নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন। প্রথম পর্বে অংশ নেয়া বেশ কিছু বিদেশি মুসল্লি দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেয়ার জন্য ময়দানের বিদেশি নিবাসে রয়ে গেছেন।
ইজতেমা আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য প্রকৌশলী মোঃ গিয়াস উদ্দিন জানান, এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দফার সকল প্রস্তুতি দ্বিতীয় দফাও বহাল রয়েছে। ইতোমধ্যে মুসুল্লিরা ইজতেমা স্থলে আসতে শুরু করেছেন। গত ১৫ জানুয়ারি (রবিবার) প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতের পর দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমার ময়দান প্রস্তুতের জন্য ইজতেমায় আগত তাবলিগ জামাতের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
তারা ইজতেমার প্রথম পর্বে মুসল্লিদের ফেলে রাখা ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে পুরো ময়দানকে উপযোগী করে তুলেছেন। এ জন্য ময়দানে তাবলিগের কর্মীরা বেশ কয়েকটি দলে বিভিক্ত হয়ে এ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালান।
এ ছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও ময়দান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজে অংশ নেয়।
এবারও বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম-উত্তর দিকে বিদেশি মুসুল্লিদের অবস্থানের জন্য বিশেষ আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বিদেশি নিবাসে রন্ধনশালায় সার্বক্ষণিক গ্যাস ও বিশুদ্ধপানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সেখানে অ্যাম্বুলেন্স ও টেলিফোনসহ প্রয়োজনীয় আধুনিক সুবিধাদি রয়েছে।
এ ছাড়াও বিদেশি নিবাসে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এবার ক্রমবর্মান বিদেশি মুসুল্লিদের জন্য ২০শতাংশ আবাসনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে বলে ইজতেমা আয়োজক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বে যে ১৭টি জেলা অংশ নিচ্ছে। ঢাকার একাংশ ও ১৬টি জেলার মুসুল্লিগণ অংশ নেবেন। দ্বিতীয় পর্বে দেশের বিভিন্ন জেলার মুসল্লীরা খিত্তাওয়ারী যেভাবে অবস্থান নেবেন তা হলো- ১ থেকে ৫ নম্বর ও ৭ নম্বর খিত্তায় ঢাকা জেলা, ৬ নম্বর খিত্তায় মেহেরপুর, ৮ নম্বর খিত্তায় লালমনিরহাট, ৯ নম্বর খিত্তায় রাজবাড়ী, ১০ নম্বর খিত্তায় দিনাজপুর, ১১ নম্বর খিত্তায় হবিগঞ্জ, ১২ ও ১৩ নম্বর খিত্তায় মুন্সীগঞ্জ, ১৪-১৫ নম্বর খিত্তায় কিশোরগঞ্জ, ১৬ নম্বর খিত্তায় কক্সবাজার, ১৭ ও ১৮ নম্বর খিত্তায় নোয়াখালী, ১৯ নম্বর খিত্তায় বাগেরহাট, ২০ নম্বর খিত্তায় চাঁদপুর, ২১ ও ২২ নম্বর খিত্তায় পাবনা, ২৩ নম্বর খিত্তায় নওগাঁ, ২৪ নম্বর খিত্তায় কুষ্টিয়া, ২৫ নম্বর খিত্তায় বরগুনা এবং ২৬ নম্বর খিত্তায় বরিশাল জেলা।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, এ দফায়ও আগের দফার মতই পোশাকে, সাদা পোশাকে পুলিশের ছয় হাজারের অধিক সদস্য পাঁচটি সেক্টরে ইজতেমার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকছে।
এ ছাড়া র্যাব, আনসার সদস্য ও ইজতেমা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কর্মীরাও তাদের সঙ্গে থাকছেন। বৃহস্পতিবার থেকেই আবার পূর্ণদ্যোমে র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা স্ব স্ব দায়িত্ব পালন শুরু করেছে।
তিনি আরো জানান, বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বে মুসল্লিদের নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম থেকে তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাও ব্যবহার করা হচ্ছে। ওয়াচ টওয়ার থেকে বাইনোকুলারে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা দিয়ে ইজতেমা মাঠ ও আশেপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ, নৌ-টহল, মোটরসাইকেল টহল ছাড়াও থাকছে স্ট্রাইকিং ফোর্স।
মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে সন্দেহভাজনদের দেহ তল্লাশীও করা হচ্ছে। র্যাবের হেলিকপ্টারও মাঠ পর্যবেক্ষণ করছে।
পাঁচ স্তরের এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ইজতেমা ময়দান এলাকা ঢেকে রাখা হয়েছে। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা যেন ঘটতে না পারে সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।
পাশাপাশি মুসল্লিদের যাতায়তের সুবিধার্থে বিআরটিসি বাস, স্যাটল সার্ভিস ও স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ব্যবস্থা আগের মতই রয়েছে।
এদিকে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) বিশেষ ট্রেন সার্ভিস ও বাস চলাচলের ব্যবস্থাগ্রহণ করেছে।
চিকিৎসা সেবা
গাজীপুরের সিভিল সার্জন জানান, প্রথম ধাপের ন্যায় দ্বিতীয় ধাপেও ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে তাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিকেল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা কারাখানার গেট অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। টঙ্গী হাসপাতালে হৃদরোগ, অ্যাজমা, ট্রমা, বার্ন, চক্ষু এবং ওআরটি কর্নারসহ বিভিন্ন ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেবেন।
এ ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ কারখানা প্রতি বছরের ন্যায় এ পর্বেও ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের ফ্রি চিকিৎসা এবং ওষুধপত্র বিতরণ শুরু করেছে।
হার্মদদ (ওয়াকফ) লিঃ, ইবনে সিনা, র্যাব-১, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, আয়ুর্বেদীয় মেডিকেল, জনকল্যাণ মেডিকেল অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে নিউ মন্নু কটন মিলের অভ্যন্তরে ফ্রি চিকিৎসা চালু করেছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত
গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে ইজতেমা মাঠ ও এর আশপাশ এলাকাকে ২০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন দুটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। বুধবার বিকেল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের কার্যক্রম শুরু করেছেন।
গাড়ি পার্কিং
প্রথম পর্বের ন্যায় দ্বিতীয় পর্বেও বিশ্ব ইজতেমায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুসল্ল¬ীদের সুবিধার্থে টঙ্গী পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ মাঠ, টঙ্গী সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী এন্ড কলেজ মাঠ, উত্তরার আজমপুর স্কুল মাঠ, কামারপাড়ায় রানাভোলা মাঠে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বী গিয়াস উদ্দিন আরো বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেয়া মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০১১সাল থেকে দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লিদের জন্য দুই দফায় বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়। ইতোপূর্বে ৬৪ জেলার মুসল্লিদের জন্য তিনদিনের এক দফায় বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে ক্রমবর্ধমাণ মুসুল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৫সাল থেকে দেশের ৩২টি জেলার মুসল্লিদের জন্য দুই দফায় বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।