র্যাব-পুলিশের পাঁচ স্তরের কঠোর নিরাপত্তায় টঙ্গীর তুরাগ তীরে আজ শুক্রবার শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ইমান-আমলের ওপর দেশি-বিদেশি বুজুর্গ-আলেম-ওলামাদের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বাদ ফজর শুরু হওয়া এই ইসলামী মহাসম্মেলন শেষ হবে আগামী রবিবার। অবশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান শুরু হয়ে গেছে।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনে ইবাদত-বন্দেগি আর কোরআন-হাদিসের আলোচনায় এখন বিশ্ব ইজতেমার ১৬০ একর জমিতে বিস্তৃত বিশাল প্যান্ডেলে পবিত্র ধর্মীয় আবহ বিরাজ করছে। সভাপতিত্বহীন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দিতে রাজধানী ঢাকাসহ দূর-দূরান্ত থেকে আগত লাখো মুসল্লির স্রোত এখন টঙ্গীর বিশাল ময়দান অভিমুখে। ট্রেন, বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলযোগে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে সমবেত হচ্ছেন। মুসল্লি সমাগমে চার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট শহর টঙ্গী রূপ নিয়েছে জনসমুদ্রে। টঙ্গীর পাশাপাশি রাজধানীর উত্তরা, তুরাগ, কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ভাসমান দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ।
বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের জন্য তুরাগ নদের তীরে ১৬০ একর জমিতে চট ও নাইলনের কাপড় দিয়ে সুবিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। বিদেশি মেহমানদের জন্য ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে টিনের ছাউনি দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে থাকা-খাওয়াসহ সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে বিদেশি নিবাসে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বিদেশি মুসল্লি মেহমানখানায় অবস্থান করছেন। আগামী রবিবার দুপুর ১২টার মধ্যে অনুষ্ঠেয় আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত তাবলিগ জামাতের দেশি-বিদেশি শীর্ষস্থানীয় মুরব্বিরা বিভিন্ন ভাষায় পর্যায়ক্রমে বয়ান করবেন। বর্তমান সময়ের মতো আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এই পর্বেও আখেরি মোনাজাতে ১৫ থেকে ২০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নিতে পারেন বলে আয়োজক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
ইজতেমাস্থলে যাতায়াতের সব সড়ক ও জনপথের রাস্তাগুলো সংস্কারের পাশাপাশি ফুট ওভারব্রিজগুলো চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা ইজতেমার প্রথম ধাপের আগেই তুরাগ নদের ওপর সাতটি ভাসমান পন্টুন সেতু নির্মাণ করেছেন। মুসল্লিদের অজু, গোসল ও খাবারের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও টঙ্গী পৌরসভার উদ্যোগে ঘণ্টায় প্রায় তিন কোটি ৫৫ লাখ গ্যালন সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অংশগ্রহণকারী জেলা ও মুসল্লিদের অবস্থান : মুসল্লির চাপ সামাল দিতে সরকার বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণের জন্য সারা দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লিদের জন্য পৃথক সময় ও পর্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। এবার দুই পর্ব মিলিয়ে মোট ৩২ জেলার মুসল্লিরা ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন। তিন দিনব্যাপী প্রথম পর্ব গত শুক্রবার শুরু হয়ে রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। ওই আয়োজনে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশের ১৬টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নেন। দ্বিতীয় পর্বে ঢাকা ও বাকি ১৬ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন।
দ্বিতীয় পর্বে ইজতেমা ময়দানে আগত মুসল্লিদের খিত্তা ও খুঁটি নম্বর অনুযায়ী অবস্থান নিতে বলা হয়েছে। মুসল্লিদের সুবিধার্থে ময়দানের উত্তর দিক থেকে ক্রমানুসারে দক্ষিণ দিকে খিত্তা ও খুঁটির নম্বর বসানো আছে। জেলাওয়ারি খিত্তা ও খুঁটির অবস্থান হলো—ঢাকা (খিত্তা নং-১, ৫ ও ৭, খুঁটি নং-৭৪০১, ৬৮০১, ৫৩০৭, ৫১১৬, ৫১২৪, ৪৭২০), মেহেরপুর (খিত্তা-৬, খুঁটি-৪৫০৭), লালমনিরহাট (খিত্তা-৮, খুঁটি-৪১২২), রাজবাড়ী (খিত্তা-৯, খুঁটি-৩৩০৭), দিনাজপুর (খিত্তা-১০, খুঁটি-৩৩২২), হবিগঞ্জ (খিত্তা-১১, খুঁটি-২৫০৭), মুন্সীগঞ্জ- (খিত্তা-১২ ও ১৩, খুঁটি-১৭০৯ ও ২১১৯), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-১৪ ও ১৫, খুঁটি-২৩২৭ ও ১১২৭), কক্সবাজার (খিত্তা-১৬, খুঁটি-৮৩৮), নোয়াখালী (খিত্তা-১৭ ও ১৮, খুঁটি-৮৪৪ ও ১৮৪০), বাগেরহাট (খিত্তা-১৯, খুঁটি-২৪৪০), চাঁদপুর (খিত্তা-২০, খুঁটি-২৪৫২), পাবনা (খিত্তা-২১ ও ২২, খুঁটি-১৪৫২ ও ৬৫০), নওগাঁ (খিত্তা-২৩, খুঁটি-৬৬২), কুষ্টিয়া (খিত্তা-২৪, খুঁটি-২৪৬২), বরগুনা (খিত্তা-২৫, খুঁটি-৭৭৭) ও বরিশাল (খিত্তা-২৬, খুঁটি-৭৮৯)।
কঠোর নিরাপত্তা : পুলিশ ও র্যাব কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, ইজতেমা ময়দানের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ পচা-বাসি ও ভেজাল খাবার রোধ এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্টের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পুলিশসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ইজতেমা ময়দানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ শুরু করেছেন। আজ থেকে ইজতেমা ময়দানের চারপাশে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাদা পোশাকধারীসহ র্যাব ও পুলিশের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি মোতায়েন রয়েছে বিপুলসংখ্যক আনসার সদস্য। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে টঙ্গীসহ আশপাশ এলাকায় গাজীপুর জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ভেজাল পণ্যসামগ্রী বেচাকেনা বন্ধ, যানবাহন নিয়ন্ত্রণসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
বিনা মূল্যে চিকিত্সাসেবা : টঙ্গী ৫০ শয্যা হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. পারভেজ জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিত্সাসেবা প্রদানে প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও ব্যাপক প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। হাসপাতালটিকে ইজতেমার জন্য অস্থায়ীভাবে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, হৃদরোগ ইউনিট, বক্ষব্যাধি/অ্যাজমা ইউনিট, ট্রমা (অর্থোপেডিক) ইউনিট, বার্ন ইউনিট, স্যানিটেশন টিম এবং পর্যাপ্ত অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ চিকিৎসকরা পালাক্রমে চিকিত্সাসেবায় নিয়োজিত থাকবেন।