ঢাকা ০৭:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির লিফলেট বিতরন শুরু ব্রিটেনে চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হতে পারে: এনএইচকেকে প্রধান উপদেষ্টা হবিগঞ্জে হাসপাতাল থেকে আসামি পালানোর ঘটনায় ২ পুলিশ সদস্য বরখাস্ত মেহের আফরোজ শাওন গ্রেপ্তার বহিষ্কৃত নেতা সাংগঠনিক টিম প্রধান! বাংলাদেশী সংস্কৃতির বিকাশ বইমেলা আয়োজনের বিকল্প নেই : মিফতাহ্ সিদ্দিকী ওয়েলস কুলাউড়া সোসাইটি ইউকের উদ্দোগে কার্ডিফে মরহুম ফিরুজ আলীর মৃত্যুতে শোক সভা ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত নো-ভিসা ফি বৃদ্ধি ও ম্যানচেস্টার থেকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট বন্ধের পায়তারার দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা নতুন দল গঠন নিয়ে বিএনপি হিংসা করে না: মির্জা আব্বাস

ভোটের রাজনীতি: দেশে-দেশে ইসলামপন্থীদের অবস্থান

1075

মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ তুরস্ক, মিসর, মালয়েশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে নির্বাচনে ভোটারদের আচরণে একটি অভিন্ন প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
প্রথমত. তুরস্ক ব্যতীত অন্যান্য দেশগুলোর এক সময় ইউরোপীয় উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অধীনে দীর্ঘকাল যাবৎ শাসিত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। উপনিবেশিক শক্তি শুধু শাসন করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে গেছে যার নেতিবাচক প্রভাব আজও তাদেরকে বহন করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত. প্রায় প্রতিটি দেশই উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তরকালে স্বাধীনতা অর্জন করে। এরূপ আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা। কোনো কোনো দেশের আন্দোলনে আলেম সমাজ বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
তৃতীয়ত. সকল দেশই বৃটিশ পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে গ্রহণ করে স্বাধীন দেশের কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু পরে কোনো দেশেই তা তেমন টেকসই হয়নি। স্বৈরতান্ত্রিক ও সামরিক শাসনের যাঁতাকলে প্রায় প্রতিটি দেশকেই নিষ্পোষিত হতে হয়েছে। একমাত্র মালয়েশিয়া বহু বাধা-বিপত্তির মধ্যেও পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে নিতে পেরেছে। অন্যান্য দেশে চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তেমন একটা আসেনি। অবশ্য সাম্প্রতিককালে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কিছুটা স্থিতিশীলতা পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
চতুর্থত. একমাত্র মালয়েশিয়া ব্যতীত অন্যান্য দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে এবং তা এখনো চলছে। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল, সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকরণ, জরুরি অবস্থা জারিকরণ, নানা ছলছুতায় দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করা মুসলিম দেশগুলোর সাধারণ রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চমত. সকল দেশই পার্লামেন্টারি পদ্ধতির আওতায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাত্রা শুরু করে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা সম্বলিত দলগুলোর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে উদার গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী কম্যুনিস্ট, ইসলামপন্থী সকল মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে। এর মধ্যে ইসলাপন্থী ও কম্যুনিস্টরা আবার অপেক্ষাকৃত অধিকতর নিপীড়নের শিকার হয়।
ষষ্ঠত. প্রায় প্রতিটি দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেয়ে আসছে। একমাত্র ইরান যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানিকে ভয় না করে এখনও মাথা উঁচু করে চলেছে। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মর্যাদাপূর্ণ নয়। মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর উপর মার্কিন প্রভাব সকলের কাছে দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মিশর ও তুরস্ক ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার এগেইনস্টে টেরর’ নীতির অন্যতম সহযোগী হিসেবে গণ্য করা হয়। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বিশেষভাবে দৃশ্যমান না হলেও সম্প্রতি তারাও ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর সাথে ‘ওয়ার এগেইনস্ট টেরর’ কর্মসূচিতে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মালয়েশিয়ার নেতা মাহাথির মোহাম্মদ পাশ্চাত্যকে তেমন পাত্তা দিতেন না। বরং কখনো কখনো কঠোর সমালোচনাও করতেন। সুদানের প্রেসিডেন্ট বশীর ইতোমধ্যে পাশ্চাত্যের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন। এর আগে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ ও পরবর্তীতে তাঁর ছেলে প্রেসিডেন্ট বাশারও পাশ্চাত্যের কাছে অপ্রিয়ভাজন বলে চিহ্নিত হয়েছেন। তুরস্কের এরদোগান সরকার পাশ্চাত্যের সাথে কৌশলগত আপন করে চলেছে। সবক’টি দেশই ইউএসএআইডি, আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক থেকে উন্নয়ন কার্যক্রম ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন সহায়তা নিয়ে থাকে।
সপ্তমত. প্রায় প্রতিটি দেশেই জাতীয়তাবাদ ও সেকুলারিজম বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তুরস্কে সাংবিধানিকভাবেই ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা রাখা হয়েছে। মিশর ও তুরস্কে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করা যায় না। তুরস্ক ব্যতীত সকল দেশেই ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। প্রায় সকল দেশেই শক্তিশালী ইসলামী রাজনৈতিক দল রয়েছে। আবার সকল দেশেই আইনের উৎস হিসেবে শরীয়াহকে কমবেশি স্বীকৃতি দেয়া হয়।
অষ্টমত. প্রায় প্রতিটি দেশেই আঞ্চলিক, নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় কারণে গোষ্ঠীগত সংঘাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং এ জন্য তাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে বা হচ্ছে। তুরস্কের কুর্দী বিদ্রোহী, সুদানের দারফুর বিদ্রোহী, ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও আচেহ প্রদেশের সংঘাত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জাতিগত সংঘাত (১৯৭১), মালয়েশিয়ায় চীনা ও ভারতীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ইত্যাদি এসব দেশের রাজনীতিতে মতপার্থক্য ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বকে মাঝে মধ্যে জটিল করে তুলে এবং বিদেশী শক্তি তা থেকে সুবিধা নেয়।
নবমত. প্রতিটি দেশেই শক্তিশালী ইসলামী আন্দোলন বা রাজনৈতিক দল রয়েছে। তারা ক্রমান্বয়ে অধিকতর জনভিত্তি গড়ে তুলছে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দক্ষতা অর্জন করছে। তাদের এই শক্তি বৃদ্ধি আবার তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোনো কোনে দেশে তারা সরকারী নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। মিশরের ব্রাদারহুড, সুদানের হাসান আল তুরাবীর ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি এবং তুরস্কে আরবাকানের পার্টিকে সামরিক সরকারের কোপানলে পড়ে বার বার নাম পাল্টাতে হয়েছে। সুদানও পাকিস্তানের ইসলামী দল সামরিক সরকারের সাথে ক্ষমতার অংশীদার হলেও তার ফল ভালো হয়নি।
দশমত. আলোচ্য দেশগুলোর পার্লামেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বলে গণ্য করার সুযোগ কম থাকলেও স্পষ্টতই লক্ষ্যণীয় যে, পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ দলগুলো নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে বিশেষ একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না। এ পর্যন্ত কোনো দেশেই ইসলামী নামধারী দলগুলো গড়ে ২০ ভাগের বেশি ভোট পায়নি। কোনো এক নির্বাচনে মোটামুটি ভাল ফল করলেও তা আর টেকসই হয়নি। অধিকাংশ দেশেই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ভোটার সংখ্যা মাত্র ৫-৭ ভাগের মত। সেক্যুলার বা জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি ভোটারদের আকর্ষণ বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। পাশাপাশি প্রায় সব দেশেই সমাজতন্ত্রী বা কম্যুনিস্ট মতাদর্শের দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির হার বেশ হতাশাব্যঞ্জক।
একাদশত. ট্রাডিশনাল বা প্রচলিত পুরানো ধাঁচের ইসলামী দলগুলোর চাইতে যে সব ইসলামী দল সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বেশি বলছে ভোটাররা তাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। তুরস্কের এ কে পার্টি ও মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের নবগঠিত জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কথাও বলা যেতে পারে। তবে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘকাল অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিবেশে কাজ করেও কেন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না তা এক গবেষণার বিষয়। একইভাবে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীই বা কেন তেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না তাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
দ্বাদশত. মুসলিম দেশগুলো বহু সমস্যা মোকাবিলা করে পার্লামেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার সাথে এগিয়ে নিতে চাইলেও পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র ও দেশীয় কুচক্রীদের কারণে তা টেকসই হতে পারছে না। বিভিন্ন সময়ে মিশর, তুরস্ক, আলজেরিয়া, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও সাম্প্রতিককালে ইরানে বিদেশী ষড়যন্ত্র নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নানাভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির লিফলেট বিতরন শুরু ব্রিটেনে

ভোটের রাজনীতি: দেশে-দেশে ইসলামপন্থীদের অবস্থান

আপডেট সময় : ১০:২১:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

1075

মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ তুরস্ক, মিসর, মালয়েশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে নির্বাচনে ভোটারদের আচরণে একটি অভিন্ন প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
প্রথমত. তুরস্ক ব্যতীত অন্যান্য দেশগুলোর এক সময় ইউরোপীয় উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অধীনে দীর্ঘকাল যাবৎ শাসিত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। উপনিবেশিক শক্তি শুধু শাসন করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে গেছে যার নেতিবাচক প্রভাব আজও তাদেরকে বহন করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত. প্রায় প্রতিটি দেশই উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তরকালে স্বাধীনতা অর্জন করে। এরূপ আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা। কোনো কোনো দেশের আন্দোলনে আলেম সমাজ বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
তৃতীয়ত. সকল দেশই বৃটিশ পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে গ্রহণ করে স্বাধীন দেশের কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু পরে কোনো দেশেই তা তেমন টেকসই হয়নি। স্বৈরতান্ত্রিক ও সামরিক শাসনের যাঁতাকলে প্রায় প্রতিটি দেশকেই নিষ্পোষিত হতে হয়েছে। একমাত্র মালয়েশিয়া বহু বাধা-বিপত্তির মধ্যেও পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে নিতে পেরেছে। অন্যান্য দেশে চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তেমন একটা আসেনি। অবশ্য সাম্প্রতিককালে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কিছুটা স্থিতিশীলতা পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
চতুর্থত. একমাত্র মালয়েশিয়া ব্যতীত অন্যান্য দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে এবং তা এখনো চলছে। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল, সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকরণ, জরুরি অবস্থা জারিকরণ, নানা ছলছুতায় দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করা মুসলিম দেশগুলোর সাধারণ রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চমত. সকল দেশই পার্লামেন্টারি পদ্ধতির আওতায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাত্রা শুরু করে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা সম্বলিত দলগুলোর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে উদার গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী কম্যুনিস্ট, ইসলামপন্থী সকল মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে। এর মধ্যে ইসলাপন্থী ও কম্যুনিস্টরা আবার অপেক্ষাকৃত অধিকতর নিপীড়নের শিকার হয়।
ষষ্ঠত. প্রায় প্রতিটি দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেয়ে আসছে। একমাত্র ইরান যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানিকে ভয় না করে এখনও মাথা উঁচু করে চলেছে। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মর্যাদাপূর্ণ নয়। মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর উপর মার্কিন প্রভাব সকলের কাছে দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মিশর ও তুরস্ক ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার এগেইনস্টে টেরর’ নীতির অন্যতম সহযোগী হিসেবে গণ্য করা হয়। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বিশেষভাবে দৃশ্যমান না হলেও সম্প্রতি তারাও ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর সাথে ‘ওয়ার এগেইনস্ট টেরর’ কর্মসূচিতে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মালয়েশিয়ার নেতা মাহাথির মোহাম্মদ পাশ্চাত্যকে তেমন পাত্তা দিতেন না। বরং কখনো কখনো কঠোর সমালোচনাও করতেন। সুদানের প্রেসিডেন্ট বশীর ইতোমধ্যে পাশ্চাত্যের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন। এর আগে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ ও পরবর্তীতে তাঁর ছেলে প্রেসিডেন্ট বাশারও পাশ্চাত্যের কাছে অপ্রিয়ভাজন বলে চিহ্নিত হয়েছেন। তুরস্কের এরদোগান সরকার পাশ্চাত্যের সাথে কৌশলগত আপন করে চলেছে। সবক’টি দেশই ইউএসএআইডি, আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক থেকে উন্নয়ন কার্যক্রম ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন সহায়তা নিয়ে থাকে।
সপ্তমত. প্রায় প্রতিটি দেশেই জাতীয়তাবাদ ও সেকুলারিজম বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তুরস্কে সাংবিধানিকভাবেই ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা রাখা হয়েছে। মিশর ও তুরস্কে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করা যায় না। তুরস্ক ব্যতীত সকল দেশেই ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। প্রায় সকল দেশেই শক্তিশালী ইসলামী রাজনৈতিক দল রয়েছে। আবার সকল দেশেই আইনের উৎস হিসেবে শরীয়াহকে কমবেশি স্বীকৃতি দেয়া হয়।
অষ্টমত. প্রায় প্রতিটি দেশেই আঞ্চলিক, নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় কারণে গোষ্ঠীগত সংঘাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং এ জন্য তাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে বা হচ্ছে। তুরস্কের কুর্দী বিদ্রোহী, সুদানের দারফুর বিদ্রোহী, ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও আচেহ প্রদেশের সংঘাত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জাতিগত সংঘাত (১৯৭১), মালয়েশিয়ায় চীনা ও ভারতীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ইত্যাদি এসব দেশের রাজনীতিতে মতপার্থক্য ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বকে মাঝে মধ্যে জটিল করে তুলে এবং বিদেশী শক্তি তা থেকে সুবিধা নেয়।
নবমত. প্রতিটি দেশেই শক্তিশালী ইসলামী আন্দোলন বা রাজনৈতিক দল রয়েছে। তারা ক্রমান্বয়ে অধিকতর জনভিত্তি গড়ে তুলছে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দক্ষতা অর্জন করছে। তাদের এই শক্তি বৃদ্ধি আবার তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোনো কোনে দেশে তারা সরকারী নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। মিশরের ব্রাদারহুড, সুদানের হাসান আল তুরাবীর ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি এবং তুরস্কে আরবাকানের পার্টিকে সামরিক সরকারের কোপানলে পড়ে বার বার নাম পাল্টাতে হয়েছে। সুদানও পাকিস্তানের ইসলামী দল সামরিক সরকারের সাথে ক্ষমতার অংশীদার হলেও তার ফল ভালো হয়নি।
দশমত. আলোচ্য দেশগুলোর পার্লামেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বলে গণ্য করার সুযোগ কম থাকলেও স্পষ্টতই লক্ষ্যণীয় যে, পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ দলগুলো নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে বিশেষ একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না। এ পর্যন্ত কোনো দেশেই ইসলামী নামধারী দলগুলো গড়ে ২০ ভাগের বেশি ভোট পায়নি। কোনো এক নির্বাচনে মোটামুটি ভাল ফল করলেও তা আর টেকসই হয়নি। অধিকাংশ দেশেই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ভোটার সংখ্যা মাত্র ৫-৭ ভাগের মত। সেক্যুলার বা জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি ভোটারদের আকর্ষণ বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। পাশাপাশি প্রায় সব দেশেই সমাজতন্ত্রী বা কম্যুনিস্ট মতাদর্শের দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির হার বেশ হতাশাব্যঞ্জক।
একাদশত. ট্রাডিশনাল বা প্রচলিত পুরানো ধাঁচের ইসলামী দলগুলোর চাইতে যে সব ইসলামী দল সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বেশি বলছে ভোটাররা তাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। তুরস্কের এ কে পার্টি ও মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের নবগঠিত জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির কথাও বলা যেতে পারে। তবে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘকাল অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিবেশে কাজ করেও কেন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না তা এক গবেষণার বিষয়। একইভাবে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীই বা কেন তেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না তাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
দ্বাদশত. মুসলিম দেশগুলো বহু সমস্যা মোকাবিলা করে পার্লামেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার সাথে এগিয়ে নিতে চাইলেও পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র ও দেশীয় কুচক্রীদের কারণে তা টেকসই হতে পারছে না। বিভিন্ন সময়ে মিশর, তুরস্ক, আলজেরিয়া, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও সাম্প্রতিককালে ইরানে বিদেশী ষড়যন্ত্র নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নানাভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।