ঢাকা ০৪:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
জাউয়াবাজারে বিএনপি নেতাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারে ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ সমাবেশ গৃহহীন পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্য জয়তুন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের উদ্যোগে সংবর্ধনা ও গৃহ নির্মাণের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত ইউরোপ এবং বাংলাদেশের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের সংলাপ বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির লিফলেট বিতরন শুরু ব্রিটেনে চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হতে পারে: এনএইচকেকে প্রধান উপদেষ্টা হবিগঞ্জে হাসপাতাল থেকে আসামি পালানোর ঘটনায় ২ পুলিশ সদস্য বরখাস্ত মেহের আফরোজ শাওন গ্রেপ্তার বহিষ্কৃত নেতা সাংগঠনিক টিম প্রধান! বাংলাদেশী সংস্কৃতির বিকাশ বইমেলা আয়োজনের বিকল্প নেই : মিফতাহ্ সিদ্দিকী ওয়েলস কুলাউড়া সোসাইটি ইউকের উদ্দোগে কার্ডিফে মরহুম ফিরুজ আলীর মৃত্যুতে শোক সভা ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত

ভ্রান্ত নারীবাদ কি পুরুষদের মানুষ করবে

1071

আমরা যারা একটা সুশীল, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজের পরিসরে চলাফেরা করি, খবরের কাগজ পড়ি, সংবাদ-মাধ্যমে চোখ রাখি, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের চলাচল জাহির করি, অর্থাৎ এই ‘আমরা’ যাঁদের নাকি গোটা সমাজ ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা রয়েছে, এবং বক্তব্য পেশ করবার অধিকার রয়েছে, তাঁরা কিন্তু পুরুষতন্ত্র, নারীর অধিকার নিয়ে সর্বদাই যথেষ্ট চিন্তিত থাকি। আমাদের এই সমাজচিন্তার অনেকটা জুড়েই থাকে লিঙ্গনির্মাণ সংক্রান্ত বিবিধ জটিল প্রকল্প।

খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় যে আমাদের এই আলোকপ্রাপ্ত নারীচিন্তার ধারাটি দ্বিবিধ। এক দিকে নারীবাদ-চর্চার অ্যাকাডেমিক ধারা: কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিংবা নারীচর্চা কেন্দ্রে আয়োজিত আলোচনাচক্র, পঠন-পাঠন, গবেষণা, জটিল সামাজিক সন্দর্ভের বিনির্মাণ। এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা সন্দেহাতীত, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের অতিসূক্ষ্ম সমালোচনা, এই অভিজাত প্রতিবাদের প্রকল্প প্রতি দিনের নারীচিন্তার গতায়াতের অনেক দূরে অবস্থিত। ফলত, নারীবাদ একটা সরল ‘বাইনারি’র ভিতরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে, তা সিনেমা-সিরিয়ালেই হোক, দৈনন্দিন যাপনেই হোক।

দ্বিতীয় ধারাটি সামাজিক, বিশ্বব্যাপী নারী-আন্দোলনের শরিক হওয়ার মহাযজ্ঞ। এর আবার অনেকগুলো দিক রয়েছে। এক দিকে যেমন রয়েছে বিবিধ নারী সংগঠন যারা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, গাঁ-গঞ্জে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেখানে অবমাননা হচ্ছে, শ্লীলতাহানি, বা ধর্ষণ হচ্ছে, সে সব জায়গায় গিয়ে তাঁরা নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বলভরসা দিচ্ছেন, তাঁর হয়ে কোর্ট-কাছারি করছেন, শত্রুপক্ষকে, এবং সেই সুবাদে প্রত্যেক পুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আর এক দিকে রয়েছেন আদ্যন্ত নাগরিক নারীবাদী, অ্যাকাডেমিক নারীবাদ থেকে সরলীকৃত কিছু ধারণা খুবলে নিয়ে সমাজের গায়ে নিক্ষেপ করছেন— স্যানিটারি ন্যাপকিনে প্রতিবাদ লিখছেন, লেলিহান প্রতিবাদে চমকে-চমকে উঠছে উদ্ধত পুরুষতন্ত্র। কিংবা, দক্ষিণ কলকাতায় (বরশুল বা মালিপাঁচঘরায় নয়) মাইল দুয়েক দেহোপজীবিনী সেজে হাঁটাচলা করছেন, পুরুষতন্ত্রের ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিচ্ছেন দেহতত্ত্ব এবং নারীদেহের চাহিদা এবং অধিকার সম্পর্কে কয়েকটা কড়া যুক্তি। আর, বাস, অটো, মোটরবাইক থেকে লোভী, ভীতু, বুভুক্ষু, কামাতুর, কৌতূহলী পুরুষতন্ত্র নিজের আশু ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় জেরবার হয়ে যাচ্ছে!

প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া জরুরি যে নারীবাদ চর্চা বা নারীবিষয়ক সমাজচিন্তার গুরুত্ব কিন্তু ক্রমাগত আরও নতুন ভাবে প্রতীয়মান। তবে এখানে একটা প্রশ্ন আছে। এই যে গুরুত্ব, সেটা ঠিক কার কাছে? কার জন্য সেটার প্রয়োজন? প্রয়োজনটা কি শুধু অ্যাকাডেমিক রয়ে যাচ্ছে, দুএকটা পেপার লেখা, কিছু জটিল বক্তৃতা, কয়েকটা পরিসংখ্যান, একটা কেরিয়ার? অথবা, কিংবা দুর্বলের পাশে দাঁড়ানোর বাহবারঞ্জিত নতুন আর একটা ক্ষমতার সমীকরণ (The subaltern/woman cannot speak!)? অথবা, বেশ হইচই ফেলে দেওয়া, টিভির পর্দায় মুখ দেখানো, প্রতিবেশীর অগাধ বিস্ময় উদ্রেক করা ক’দিনের নারীবাদের কাগুজে বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠার প্রমোদের মেলা? এই নারীবাদ চর্চা কি আদৌ একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরের পুরুষের চিন্তায় কোনওভাবে ছাপ ফেলতে পারছে?

এই প্রসঙ্গে বলি, কিছু কাল আগে একটি বেসরকারি সংস্থার আমন্ত্রণে একটা অভিনব সাক্ষাৎকারে গিয়েছিলাম। সেখানে ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আসা জনা পঞ্চাশেক যুবক। বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে। আমার কাজ, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতার ভিতর দিয়ে তাঁদের সামাজিক বোধ, সংবেদনশীলতা, কর্পোরেট পরিবেশে মানিয়ে চলবার ক্ষমতা সম্বন্ধে আন্দাজ পাওয়া। এঁরা সকলেই প্রথম কলকাতা শহরে এসেছেন। জিজ্ঞাসা করি, ‘কেমন লাগছে?’ উত্তরে প্রায় সকলেই একমত। এই শহরের সবই ভাল, মানুষজন খুবই বন্ধুবৎসল, তবে কিনা রাস্তাঘাটে মেয়েরা অবাধে ধূমপান করছে, এইটা কিছুতেই মেনে নেওয়া চলে না। ক্রমাগত আলোচনা এগোল তাঁদের জীবন নিয়ে। বেশির ভাগই এসেছেন শহরতলি থেকে, অনেকে সরাসরি গ্রাম থেকে। সেখানে ভাল ডাক্তার নেই। জিজ্ঞাসা করি, ‘একজন ডাক্তারকে বিয়ে করলে কেমন হয়?’ উত্তর আসে, তা কী করে সম্ভব! স্ত্রী ডাক্তার হলে বৃদ্ধ মা-বাবাকেই বা কে দেখবে আর সন্তানদের খেয়ালই বা কে রাখবে? আর একটু এগোই, ‘ভালই তো, বাড়িতে এক জন ডাক্তার থাকলে, মা-বাবার সেবা আরও ভাল হবে’। জবাব আসে, বাপ-মায়ের চিকিৎসা তাঁরা নিজের রোজগারে করাবেন, স্ত্রী তাঁদের সেবাযত্নটুকু করলেই যথেষ্ট। এর পর আলোচনা যেদিকে গড়ায়, তা নারীবাদের নিরিখে বিস্ফোরক। জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা, ধরুন আপনার স্ত্রী যদি আপনার থেকে বেশি উপার্জন করেন, তা হলে কেমন হবে?’ পরিশীলিত হিন্দিতে এ কজন অত্যন্ত ঝকঝকে যুবক যা বললেন তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: মেয়েমানুষের রোজগারের টাকায় রুটি কেনা ‘হারাম’। দেখে আশ্চর্য হলাম যে দলের অধিকাংশ যুবক নিঃসংশয়ে ওঁকে সমর্থন জানাল। এই শেষ অংশের একটা ধর্মকেন্দ্রিক নিরিখ নিশ্চয়ই রয়েছে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ আলাদা, তার আলোচনা আরও জটিল ও দীর্ঘ।

আদত কথা হল এই যে আমাদের দেশে বহু বহু শিক্ষিত যুবক দ্বিধাহীন ভাবে এমন ধারণা পোষণ করেন, এবং সমান দ্বিধাহীন ভাবে তা প্রকাশ করে থাকেন। এখানে একটা সংশয় উশকে রাখা ভাল যে, প্রান্তিক সারল্যে যে কথা এঁরা অনায়াসে প্রকাশ করে ফেললেন, তার অনুরণন কি আমাদের শহুরে, মধ্যবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত সমাজে একেবারেই অনুপস্থিত? উত্তরটা কী, আমরা সবাই জানি।

আবার ‘আমাদের’ নারীবাদে ফিরে আসি। মনে মনে এর একটা নামকরণ করেছি: bad feminism বা ভ্রান্ত নারীবাদ। যে নারীবাদ গড়ে উঠতে চায় পুরুষকে বাদ দিয়ে। ঠিক যে ভাবে নারীকে ব্রাত্য করে পুরুষ তাঁর তন্ত্র রচনা করেছে, ঠিক তারই পাল্টা। এতে যা হয়েছে, তা ওই কাশ্মীির যুবকদের উদাহরণে প্রকাশ করলাম। পুরুষ এখনও মানুষ হল না, এখনও সে নিতান্ত পুরুষমানুষ থেকে গেল। আর ভ্রান্ত-নারীবাদ শুধু ব্যস্ত থাকল একপেশে লিঙ্গধারণা (hetero-normativity) খুঁজতে, চুলচেরা সমালোচনা করতে। যে দ্বিত্ব বা ‘বাইনারি’র ভাবনা পুরুষতন্ত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন তৈরি করে এসেছে, সেই একই বিভাজনের ধারা এই সস্তা নারীবাদেও ক্রমাগত চলতে থাকল। ‘আমি যদি তোমার জন্য চা বানাই, তুমি আমার খাবার বেড়ে দেবে’ গোছের সহজ সমীকরণ। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ‘মাতৃভূমি’ লোকাল। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে চলতে পারে না, যেন প্রত্যেক পুরুষই কোনও নারীকে দেখামাত্র তার লোলুপ হাত বাড়িয়ে দেবে, এই সরল দ্বিমাত্রিক সমীকরণ থেকেই এমন ট্রেনের প্রয়োজন হয়। এই প্রতিযোগিতায় এ বার প্রগল্ভ, অশালীন পুরুষতন্ত্র তার ভাগ দাবি করতে শুরু করে ‘পিতৃভূমি’ লোকাল দিয়ে। যৌন বিভাজনের ভিত্তিতে জমি দখলের লড়াই। আমরা কী করব? দুটো দল বানিয়ে হাততালি দেব?

আসলে নারীবাদের প্রকল্পটা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। নারীবাদের নানা আঙ্গিক ভরসা করে নারী হয়তো বদলে চলবে প্রতিদিন। পুরুষ কিন্তু একই জায়গায় স্থবির। প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদ একজন প্রতিপক্ষ চেয়েছে, যাকে চোখ রাঙানো যায়, শায়েস্তা করা যায়, বা ফাঁসিতে চড়িয়ে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। অথচ যে পুরুষের আলোকপ্রাপ্তি প্রয়োজন, সে রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। তার দায়িত্বও নারীকেই বুঝি নিতে হবে। না হলে পুরুষের আর মানুষ হওয়ার সম্ভবনা দেখি না। তবে কিনা, এই কাজ শুধু গাল পেড়ে হবে না, এর জন্য প্রয়োজন যত্ন আর শুশ্রূষা। এই মঙ্গলসাধনের ভিতরেই বোধহয় প্রোথিত রয়েছে নতুন ক্ষমতায়নের বীজ।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

জাউয়াবাজারে বিএনপি নেতাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারে ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ সমাবেশ

ভ্রান্ত নারীবাদ কি পুরুষদের মানুষ করবে

আপডেট সময় : ১০:০০:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

1071

আমরা যারা একটা সুশীল, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজের পরিসরে চলাফেরা করি, খবরের কাগজ পড়ি, সংবাদ-মাধ্যমে চোখ রাখি, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের চলাচল জাহির করি, অর্থাৎ এই ‘আমরা’ যাঁদের নাকি গোটা সমাজ ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা রয়েছে, এবং বক্তব্য পেশ করবার অধিকার রয়েছে, তাঁরা কিন্তু পুরুষতন্ত্র, নারীর অধিকার নিয়ে সর্বদাই যথেষ্ট চিন্তিত থাকি। আমাদের এই সমাজচিন্তার অনেকটা জুড়েই থাকে লিঙ্গনির্মাণ সংক্রান্ত বিবিধ জটিল প্রকল্প।

খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় যে আমাদের এই আলোকপ্রাপ্ত নারীচিন্তার ধারাটি দ্বিবিধ। এক দিকে নারীবাদ-চর্চার অ্যাকাডেমিক ধারা: কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিংবা নারীচর্চা কেন্দ্রে আয়োজিত আলোচনাচক্র, পঠন-পাঠন, গবেষণা, জটিল সামাজিক সন্দর্ভের বিনির্মাণ। এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা সন্দেহাতীত, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের অতিসূক্ষ্ম সমালোচনা, এই অভিজাত প্রতিবাদের প্রকল্প প্রতি দিনের নারীচিন্তার গতায়াতের অনেক দূরে অবস্থিত। ফলত, নারীবাদ একটা সরল ‘বাইনারি’র ভিতরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে, তা সিনেমা-সিরিয়ালেই হোক, দৈনন্দিন যাপনেই হোক।

দ্বিতীয় ধারাটি সামাজিক, বিশ্বব্যাপী নারী-আন্দোলনের শরিক হওয়ার মহাযজ্ঞ। এর আবার অনেকগুলো দিক রয়েছে। এক দিকে যেমন রয়েছে বিবিধ নারী সংগঠন যারা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, গাঁ-গঞ্জে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেখানে অবমাননা হচ্ছে, শ্লীলতাহানি, বা ধর্ষণ হচ্ছে, সে সব জায়গায় গিয়ে তাঁরা নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বলভরসা দিচ্ছেন, তাঁর হয়ে কোর্ট-কাছারি করছেন, শত্রুপক্ষকে, এবং সেই সুবাদে প্রত্যেক পুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আর এক দিকে রয়েছেন আদ্যন্ত নাগরিক নারীবাদী, অ্যাকাডেমিক নারীবাদ থেকে সরলীকৃত কিছু ধারণা খুবলে নিয়ে সমাজের গায়ে নিক্ষেপ করছেন— স্যানিটারি ন্যাপকিনে প্রতিবাদ লিখছেন, লেলিহান প্রতিবাদে চমকে-চমকে উঠছে উদ্ধত পুরুষতন্ত্র। কিংবা, দক্ষিণ কলকাতায় (বরশুল বা মালিপাঁচঘরায় নয়) মাইল দুয়েক দেহোপজীবিনী সেজে হাঁটাচলা করছেন, পুরুষতন্ত্রের ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিচ্ছেন দেহতত্ত্ব এবং নারীদেহের চাহিদা এবং অধিকার সম্পর্কে কয়েকটা কড়া যুক্তি। আর, বাস, অটো, মোটরবাইক থেকে লোভী, ভীতু, বুভুক্ষু, কামাতুর, কৌতূহলী পুরুষতন্ত্র নিজের আশু ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় জেরবার হয়ে যাচ্ছে!

প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া জরুরি যে নারীবাদ চর্চা বা নারীবিষয়ক সমাজচিন্তার গুরুত্ব কিন্তু ক্রমাগত আরও নতুন ভাবে প্রতীয়মান। তবে এখানে একটা প্রশ্ন আছে। এই যে গুরুত্ব, সেটা ঠিক কার কাছে? কার জন্য সেটার প্রয়োজন? প্রয়োজনটা কি শুধু অ্যাকাডেমিক রয়ে যাচ্ছে, দুএকটা পেপার লেখা, কিছু জটিল বক্তৃতা, কয়েকটা পরিসংখ্যান, একটা কেরিয়ার? অথবা, কিংবা দুর্বলের পাশে দাঁড়ানোর বাহবারঞ্জিত নতুন আর একটা ক্ষমতার সমীকরণ (The subaltern/woman cannot speak!)? অথবা, বেশ হইচই ফেলে দেওয়া, টিভির পর্দায় মুখ দেখানো, প্রতিবেশীর অগাধ বিস্ময় উদ্রেক করা ক’দিনের নারীবাদের কাগুজে বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠার প্রমোদের মেলা? এই নারীবাদ চর্চা কি আদৌ একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরের পুরুষের চিন্তায় কোনওভাবে ছাপ ফেলতে পারছে?

এই প্রসঙ্গে বলি, কিছু কাল আগে একটি বেসরকারি সংস্থার আমন্ত্রণে একটা অভিনব সাক্ষাৎকারে গিয়েছিলাম। সেখানে ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আসা জনা পঞ্চাশেক যুবক। বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে। আমার কাজ, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতার ভিতর দিয়ে তাঁদের সামাজিক বোধ, সংবেদনশীলতা, কর্পোরেট পরিবেশে মানিয়ে চলবার ক্ষমতা সম্বন্ধে আন্দাজ পাওয়া। এঁরা সকলেই প্রথম কলকাতা শহরে এসেছেন। জিজ্ঞাসা করি, ‘কেমন লাগছে?’ উত্তরে প্রায় সকলেই একমত। এই শহরের সবই ভাল, মানুষজন খুবই বন্ধুবৎসল, তবে কিনা রাস্তাঘাটে মেয়েরা অবাধে ধূমপান করছে, এইটা কিছুতেই মেনে নেওয়া চলে না। ক্রমাগত আলোচনা এগোল তাঁদের জীবন নিয়ে। বেশির ভাগই এসেছেন শহরতলি থেকে, অনেকে সরাসরি গ্রাম থেকে। সেখানে ভাল ডাক্তার নেই। জিজ্ঞাসা করি, ‘একজন ডাক্তারকে বিয়ে করলে কেমন হয়?’ উত্তর আসে, তা কী করে সম্ভব! স্ত্রী ডাক্তার হলে বৃদ্ধ মা-বাবাকেই বা কে দেখবে আর সন্তানদের খেয়ালই বা কে রাখবে? আর একটু এগোই, ‘ভালই তো, বাড়িতে এক জন ডাক্তার থাকলে, মা-বাবার সেবা আরও ভাল হবে’। জবাব আসে, বাপ-মায়ের চিকিৎসা তাঁরা নিজের রোজগারে করাবেন, স্ত্রী তাঁদের সেবাযত্নটুকু করলেই যথেষ্ট। এর পর আলোচনা যেদিকে গড়ায়, তা নারীবাদের নিরিখে বিস্ফোরক। জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা, ধরুন আপনার স্ত্রী যদি আপনার থেকে বেশি উপার্জন করেন, তা হলে কেমন হবে?’ পরিশীলিত হিন্দিতে এ কজন অত্যন্ত ঝকঝকে যুবক যা বললেন তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়: মেয়েমানুষের রোজগারের টাকায় রুটি কেনা ‘হারাম’। দেখে আশ্চর্য হলাম যে দলের অধিকাংশ যুবক নিঃসংশয়ে ওঁকে সমর্থন জানাল। এই শেষ অংশের একটা ধর্মকেন্দ্রিক নিরিখ নিশ্চয়ই রয়েছে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ আলাদা, তার আলোচনা আরও জটিল ও দীর্ঘ।

আদত কথা হল এই যে আমাদের দেশে বহু বহু শিক্ষিত যুবক দ্বিধাহীন ভাবে এমন ধারণা পোষণ করেন, এবং সমান দ্বিধাহীন ভাবে তা প্রকাশ করে থাকেন। এখানে একটা সংশয় উশকে রাখা ভাল যে, প্রান্তিক সারল্যে যে কথা এঁরা অনায়াসে প্রকাশ করে ফেললেন, তার অনুরণন কি আমাদের শহুরে, মধ্যবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত সমাজে একেবারেই অনুপস্থিত? উত্তরটা কী, আমরা সবাই জানি।

আবার ‘আমাদের’ নারীবাদে ফিরে আসি। মনে মনে এর একটা নামকরণ করেছি: bad feminism বা ভ্রান্ত নারীবাদ। যে নারীবাদ গড়ে উঠতে চায় পুরুষকে বাদ দিয়ে। ঠিক যে ভাবে নারীকে ব্রাত্য করে পুরুষ তাঁর তন্ত্র রচনা করেছে, ঠিক তারই পাল্টা। এতে যা হয়েছে, তা ওই কাশ্মীির যুবকদের উদাহরণে প্রকাশ করলাম। পুরুষ এখনও মানুষ হল না, এখনও সে নিতান্ত পুরুষমানুষ থেকে গেল। আর ভ্রান্ত-নারীবাদ শুধু ব্যস্ত থাকল একপেশে লিঙ্গধারণা (hetero-normativity) খুঁজতে, চুলচেরা সমালোচনা করতে। যে দ্বিত্ব বা ‘বাইনারি’র ভাবনা পুরুষতন্ত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন তৈরি করে এসেছে, সেই একই বিভাজনের ধারা এই সস্তা নারীবাদেও ক্রমাগত চলতে থাকল। ‘আমি যদি তোমার জন্য চা বানাই, তুমি আমার খাবার বেড়ে দেবে’ গোছের সহজ সমীকরণ। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ‘মাতৃভূমি’ লোকাল। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে চলতে পারে না, যেন প্রত্যেক পুরুষই কোনও নারীকে দেখামাত্র তার লোলুপ হাত বাড়িয়ে দেবে, এই সরল দ্বিমাত্রিক সমীকরণ থেকেই এমন ট্রেনের প্রয়োজন হয়। এই প্রতিযোগিতায় এ বার প্রগল্ভ, অশালীন পুরুষতন্ত্র তার ভাগ দাবি করতে শুরু করে ‘পিতৃভূমি’ লোকাল দিয়ে। যৌন বিভাজনের ভিত্তিতে জমি দখলের লড়াই। আমরা কী করব? দুটো দল বানিয়ে হাততালি দেব?

আসলে নারীবাদের প্রকল্পটা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। নারীবাদের নানা আঙ্গিক ভরসা করে নারী হয়তো বদলে চলবে প্রতিদিন। পুরুষ কিন্তু একই জায়গায় স্থবির। প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদ একজন প্রতিপক্ষ চেয়েছে, যাকে চোখ রাঙানো যায়, শায়েস্তা করা যায়, বা ফাঁসিতে চড়িয়ে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। অথচ যে পুরুষের আলোকপ্রাপ্তি প্রয়োজন, সে রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। তার দায়িত্বও নারীকেই বুঝি নিতে হবে। না হলে পুরুষের আর মানুষ হওয়ার সম্ভবনা দেখি না। তবে কিনা, এই কাজ শুধু গাল পেড়ে হবে না, এর জন্য প্রয়োজন যত্ন আর শুশ্রূষা। এই মঙ্গলসাধনের ভিতরেই বোধহয় প্রোথিত রয়েছে নতুন ক্ষমতায়নের বীজ।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক