বিশেষ প্রতিনিধি : নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটি বিএনপিসহ এর নেতৃত্বাধীন জোট প্রত্যাখ্যান করল। তারা বলছে, নতুন সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে আবারও দেশকে অন্ধকার গহ্বরের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।
যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে তাতে নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই। এই কমিটি কিছুতেই গ্রহণ করা যায় না। ঘোষিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হলে দেশের রাজনৈতিক সংঘাত আরো বাড়বে। গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে।
সার্চ কমিটি গঠনের পর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দুই বিচারপতির ব্যাপারে এখনই কিছু বলব না। ’ তবে সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ সরকারের লাভজনক পদে আছেন। তিনি নিরপেক্ষ হন কিভাবে? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘তাঁকে আমরা মানতে পারছি না। ’ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ব্যাপারে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তাঁর ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে পারছি না। আর শিরীণ আখতার আওয়ামী পরিবারের লোক। ’ ফখরুল বলেন, গঠিত সার্চ কমিটিতে নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছিল বিএনপি। এ ছাড়া দলটি ‘বিতর্কিত নন এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের’ সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিল। আর বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে বিএনপির প্রস্তাব ছিল অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মক্ষম সাবেক একজন প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ। কিন্তু কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আপিল বিভাগের বর্তমান একজন বিচারপতিকে। একইভাবে বাছাই কমিটির সদস্য হিসেবে বিতর্কিত নন অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের এমন একজন বিচারপতিকে বিএনপি নিয়োগের প্রস্তাব করেছিল। তবে উভয় ক্ষেত্রে শর্তারোপ করে দলটি বলেছিল—অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত আছেন বা ছিলেন এমন কেউ সদস্য হতে পারবেন না। বিএনপির প্রস্তাবিত কমিটিতে অবসরপ্রাপ্ত সচিবকে সদস্য করার কোনো প্রস্তাব ছিল না। কিন্তু গঠিত সার্চ কমিটিতে সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদকে সদস্য করা হয়েছে। যে পদটিকে বিএনপি ‘লাভজনক’ বলে অভিহিত করেছে।
এদিকে বাছাই কমিটিতে একজন নারী সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; যেটি বিএনপির প্রস্তাবেও ছিল। তবে বিএনপির প্রস্তাব অনুযায়ী ওই নারী সদস্য নিরপেক্ষ নন। তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারের লোক বলে মনে করে দলটি।
এ ছাড়া বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিত দলনিরপেক্ষ এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে সার্চ কমিটির সদস্য করার সুপারিশ ছিল বিএনপির। এ যোগ্যতা বা ‘ক্রাইটেরিয়া’য় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম পড়েন।
গতকাল বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি আয়োজিত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র-শহীদ জিয়া : আজকের প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব বলেন, রাষ্ট্রপতি একটি প্রতিষ্ঠান। বিএনপির আশা করেছিল, তাঁর কাছ থেকে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। সংকট নিরসনে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। এখনই বোঝা যাচ্ছে, বাছাই কমিটি কী ধরনের ইসি গঠন করবে। এই কমিটির মাধ্যমে আবারও অন্ধকার গহ্বরের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া হলো।
সার্চ কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শিরিন আক্তার। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া তাঁর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, “টিভি চ্যানেলকে টেলিফোনে তিনি বলেছেন, ‘আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব, পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি আমাকে যে দায়িত্ব দেবেন, তা পবিত্র দায়িত্ব মনে করে পালনে সচেষ্ট হব। ’ বুঝে নিন, কী নিরপেক্ষ একটি সার্চ কমিটি গঠন হয়েছে। শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন জাতীয় পার্টি ছাড়া সবাই বর্জন করেছিল। সেই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার দেওয়া দায়িত্ব তিনি সূচারু রূপে পালন করবেন। সুতরাং নিরপেক্ষতার চরম নিদর্শন মহামান্য রাষ্ট্রপতি দিয়েছেন। কী নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। আমরা শুধু হতাশই হয়নি, ক্ষুব্ধও হয়েছি। ”
ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত পত্রপত্রিকা আর অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছয়জনকে নিয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। রাষ্ট্রপতি আলোচনা শুরুর পরে একটি আশার আলো দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে, চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যে সার্চ কমিটি গঠন হয়েছে, তা আওয়ামী লীগ সরকারের পছন্দের কমিটি। কারণ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য—এগুলো সরকারের নিয়োগ। দেশের রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তিনি তা নষ্ট করেছেন। ’
ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ অতীত ভুলে যায়—এমন দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তারা কথা বলার সময় ’৭৫-পরবর্তী অবস্থার কথা বলে। আগের কোনো কথা বলতে চায় না। তারা কেন বাকশাল কায়েম করেছিল, গণতন্ত্র ধ্বংস করেছিল, তারা তা বলে না। আমাদের জনগণকে জাগাতে হবে, জানাতে হবে। জনগণের শক্তির মধ্য দিয়ে এই অপশক্তিকে অপসারিত করতে হবে। ২০ দলীয় জোট, বিএনপি ও অন্য সব প্রতিষ্ঠানসহ সব গণতান্ত্রিক মানুষের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে, এই সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে নামা। ’
লেবার পার্টির সভাপতি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের সভাপতিত্বে সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির সাধারণ সম্পাদক হামদুল্লাহ আল মেহেদী প্রমুখ।
জোট শরিকদের প্রতিক্রিয়া
কল্যাণ পার্টি
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমের মতে, এই সার্চ কমিটি জাতিকে আশার আলো দেখাতে পারবে না। অতএব উনাদের (সরকার) সার্চের মাধ্যমে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে সেটিও আশাপ্রদ হবে না বলেই মনে করা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, যদি অধিকতর উদারতা নিয়ে এবং অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করা হতো তাহলে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও খুশি হতেন; দেশবাসীও খুশি হতো।
বিজেপি
২০ দলীয় জোটের শরিক বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ঘোষিত সার্চ কমিটিতে জাতির আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। কারণ দেশবাসী মনে করেছিল; সরকার সংঘাত সৃষ্টি না করে গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসি পুনর্গঠন করে বিদ্যমান সংকট থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি যে কমিটি করলেন তাতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত আরো বাড়বে এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে।
জাগপা
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপার চেয়ারম্যান শফিউল আলম প্রধান বলেন, যে সার্চ কমিটি দেখা গেল তাতে মনে হয় সংকট সমাধানের সুরঙ্গপথের শেষ আলোটি নিভে গেল। তাঁর মতে, ভরসা এবং প্রত্যাশার সর্বশেষ ঠিকানা ছিল বঙ্গভবন। কিন্তু সেই বঙ্গভবন জাতীয় প্রত্যাশাকে হতাশ করেছে।
এলডিপি
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘ঘোষিত সার্চ কমিটি দেখে আমরা হতাশ হয়েছি। কারণ আমরা আশা করেছিলাম, রাষ্ট্রপতি দলের চেয়ে দেশের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য দেবেন। কিন্তু আমাদের সেই আশার আলো নিভে গেল। গণতন্ত্রের উত্তরণের আর কোনো পথ খোলা রইল না। ’
সার্চ কমিটিতে দলীয় লোক থাকলে মানব না : রিজভী
এদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সার্চ কমিটিতে দলীয় লোক থাকলে তা মেনে নেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ। তিনি বলেছেন, সার্চ কমিটিতে যদি আবারও দলীয় লোকের নাম থাকে, আমরা আগেই বলেছি আবারও বলছি তা আমরা মানব না। দেশের সাধারণ জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করব। ’
গতকাল দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিলনায়তনে ২৫ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবসকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক সংসদ নামের একটি সংগঠন আয়োজিত আলোচনা সভায় রিজভী এ কথা বলেন।
রিজভী বলেন, আবারও রকিবুল্লাহ-করিমুল্লাহ মার্কা নির্বাচন কমিশন গঠন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। এ নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করা ছাড়া বিএনপির কোনো বিকল্প থাকবে না। সুতরাং আশা করি রাষ্ট্রপতি এমন উদ্যোগ নেবেন যাতে বিএনপি এর বিরোধিতা না করে।