তাজ উদ্দীন
বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়াউর রহমান এক বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র গঠনে তার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা মত প্রচলিত আছে। এই প্রবন্ধে, আমরা ইতিহাসের কিছু তথ্য এবং ঘটনার আলোকে জিয়াউর রহমানের জীবনের কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বই ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’ এ ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পূর্বে মেজর ফারুক ও রশিদদের সাথে জিয়ার কথোপকথনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। মাসকারেনহাস লিখেছেন, ফারুক-রশিদ যখন জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে অপসারণ করার প্রস্তাব দেন, তখন জিয়া সরাসরি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, “আমি এটার সাথে নেই। তোমরা জুনিয়ররা যদি কিছু কর, সেটা তোমাদের দায়িত্ব!” এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, জিয়া সরাসরি অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন না।
১৫ই আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যখন ফারুক-রশিদ জিয়াউর রহমানের কাছে যান এবং তাঁকে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেন, তখন জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হননি, বরং পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে মোকাবিলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছে তো কি হয়েছে! ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছেন। তোমরা চলে যাও।” জিয়ার এই নির্লিপ্ততা সেদিন অনেককেই বিস্মিত করেছিল।
তবে, ১৫ই আগস্টের পর থেকে ৩ নভেম্বরের খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান পর্যন্ত বেশ কিছু ঘটনা ঘটে, যা জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জিয়াকে বন্দি করা হয় এবং তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কিন্তু ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। এই বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন।
জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহণের পর, তিনি দেশের পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। তিনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং দেশের রাজনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের—সব মহলেই তিনি এক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
তবে, রাজনৈতিক কারণে কেউ কেউ শহিদ জিয়াকে ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে মনে করেন, যদিও এর সপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু মাসকারেনহাসের বইয়ে ফারুক-রশিদের জবানবন্দি এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিয়া সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না।
জিয়াউর রহমান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সেনাপতি এবং একজন রাষ্ট্রনায়ক। তার অবদান এবং কর্ম বাংলাদেশের ইতিহাসে সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার মূল্যায়ন না করে, বরং ইতিহাসের আলোকে একজন বহুমাত্রিক চরিত্র হিসেবে তাকে বিবেচনা করা উচিত। জিয়াউর রহমান কোনো খুনি নন, বরং তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পুনর্গঠক। কোনো অপপ্রচার বা মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে তার চরিত্রকে কলঙ্কিত করা উচিত নয়।
প্রতিনিধির নাম 










