নির্বাচন কমিশন: শুভংকরের ফাঁকিতে আবারও বিএনপি!
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৫৯:২২,অপরাহ্ন ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ৯৭০ বার পঠিত
নির্বাচন কমিশন: শুভংকরের ফাঁকিতে আবারও বিএনপি!
ফারুক ওয়াসিফ
নতুন সিইসি মনোনয়ন প্রক্রিয়াটা ছিল বিএনপির জন্য একটা ফাঁদ। রাষ্ট্রপতি ও অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে সলাপরামর্শের মধ্যে ঢুকে বিএনপি আসলে সরকার প্রণীত সুড়ঙ্গেই পা বাড়াল। এর শেষ প্রান্তে আলো থাকুক বা না থাকুক, বিএনপিকে এর মধ্যেই এখন দৌড়াতে হবে। অন্ধকার সেই সুড়ঙ্গটিকে আরও সরু করে ফেলা হলো নতুন সিইসি মনোনয়নের নাটকের মধ্য দিয়ে।
ধাপগুলো খেয়াল করুন। বিএনপির এক দফা এক দাবি ছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেটা না হওয়ায় গত সংসদ নির্বাচন তারা বয়কট করেছিল। সেই সুযোগ সংবিধানেও নেই, সরকারের চিন্তাতেও নেই। নির্বাচনকালীন আলাদা সরকারই যদি না থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশন কেমন হলো বা না হলো, তাতে বিএনপির কিছু এসে যাওয়ার কথা নয়। যদি নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু না-ই হয়, তাহলে নিরপেক্ষ বা যোগ্য সিইসি দিয়ে কী হবে? সব জেনেশুনেও বিএনপিকে মৌলিকভাবে পিছু হঠতে হলো। বিএনপি এভাবে সরকার-নির্ধারিত ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। কারণ, ক্রিয়া করার মেধা, বুদ্ধি ও শক্তি না থাকলে প্রতিক্রিয়াই করে যেতে হয়।
সিইসি মনোনয়ন নিয়ে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ছিল সরকারের একটা ক্রিয়া। বাকিরা যা করেছে তা প্রতিক্রিয়া মাত্র। তাই বিএনপিকেও যাবতীয় বাদবিসংবাদ ও দর-কষাকষি চালাতে হলো সিইসি পদ ঘিরেই। গাড়ির চালক যদি না বদলায় তাহলে চালকের সহকারী বদলে ফায়দা কী? যদি সরকার ও প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগ নিরপেক্ষতা বজায় না রাখে তবে নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা কোনো কাজেই আসবে না। বাস্তবিক অর্থেও বাংলাদেশে আজ অবধি দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সুতরাং সিইসি নিয়ে পরামর্শ, অভিযোগ, আপত্তির এই খেলায় বিএনপির লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তারপরও এর মধ্যে তাদের ঢুকতে হয়েছে। নইলে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসত, বিএনপি আলোচনা-সমঝোতায় বিশ্বাসী নয়।
বিএনপিকে কৌশলে অবান্তর বিষয়ে আটকে রাখার এই সরকারি কৌশলের নাম ‘বিগ পট ট্যাক্টিস’। দুই বিরোধী পক্ষের আলোচনা বা দর-কষাকষিতে এই কৌশল বেশ কাজে লাগে। এই কৌশলের তরিকা হলো, আপনি আলোচনায় এমন একটা ইস্যু টেনে আনবেন, যেটা আসলে আপনার জন্যও কিছু না প্রতিপক্ষের জন্যও কিছু না। কিন্তু আপনি এটাকে এমন গুরুত্ব দেবেন যেন প্রতিপক্ষও ভেবে বসে এটা আসলেই বড় ইস্যু। এটা নিয়ে কঠিন দর-কষাকষির পর আপনি কিছুটা ছাড় দেবেন। তাতে প্রতিপক্ষ কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যাবে। তাদের কথা শোনা হয়নি সেই অভিযোগ করা তখন কঠিন হবে। তখন তাদেরও ছাড় দিতে লাগবে। তারপর আসল খেলাটা হবে মূল ইস্যুতে; যেখানে আপনি কোনো ছাড়ই দেবেন না। এখানে মূল ইস্যু হলো নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন, আর বানিয়ে বড় করা ইস্যু হলো সিইসি পদধারীর নাম বাছাইয়ের মহড়া।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষে আমেরিকা এই খেলাই খেলেছিল ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করার বেলায়। আমেরিকানরা গোঁ ধরল, আলোচনার টেবিল হবে চার কোনা। ভিয়েতনামিরা পাল্টা জেদ ধরল, টেবিল হতে হবে গোল, যাতে সব পক্ষকে সমান মনে হয়। এই নিয়ে বহু বাদ–বিবাদের পর সমঝোতা হয়, গোলটেবিলই সই। আমেরিকানরা এটাই চেয়েছিল। টেবিলের বিষয়ে ছাড় দিয়ে মূল ইস্যুগুলোতে তারা কঠিন অবস্থান নেয় এবং সুবিধা অর্জন করে।
সিইসি কে হবেন না হবেন, তা নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে, রাষ্ট্রপতিকে জড়িত করে, আপাত গ্রহণযোগ্য অনুসন্ধান কমিটি করে সরকার বিরাট ইস্যু বানিয়ে ফেলল। বিএনপিও তা নিয়ে মাতল। সরকার বিএনপির প্রস্তাব থেকে একজনকে রেখে একধরনের ছাড়ও দিল। কিন্তু নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বিএনপির থেকে আরও দূরেই চলে গেল। বিএনপি এখন গাইতে পারে গানটা: ‘আগে জানতাম যদি শুভংকরের ফাঁকি, আমার ভাগে পড়ত না ভাই শূন্য!’
উল্টো দিক থেকে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করা যাক। উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার এবং তাঁদের প্রধানজন নিযুক্ত হলেন। যদি সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন না থাকে, তাহলে এ ঘটনার কোনো গুরুত্ব থাকার কথা নয়। আর যদি গুরুত্ব থাকে, তার মানে সামনে সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচন আসছে। যাঁরা নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে উৎসাহী তাঁরা হয়তো বিশ্বাস করেন, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা খুবই পাতলা। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনকেই বিরোধীপক্ষ সুষ্ঠু বলে মেনে নেয়নি। ভবিষ্যতেও সেই ধারাবাহিকতাই বজায় থাকার সম্ভাবনা ষোলো আনা। তা যদি হয়, তাহলে সিইসি মনোনয়নের খেলায় বিএনপির কিছু পাওয়া দূরে থাক, বরং অনেক কিছুই হারিয়েছে।
এখন তাদের সামনে দুটি মাত্র পথ। হয় এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই না করা। অথবা এই সরকারের অধীনে, এই নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব মেনেই নির্বাচনে দাঁড়ানো। নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় যোগ দিয়ে বিএনপি দ্বিতীয় পথেই এগোলো। এর বাইরে আরেকটা বিকল্প হলো আন্দোলন। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, বড় গণ-আন্দোলন ছাড়া সত্যিকার সুষ্ঠু কোনো নির্বাচন এই দেশে হয়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, উনসত্তরের অভ্যুত্থানের পর সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়, ছিয়ানব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের বিজয় এর প্রমাণ। বিগত জরুরি অবস্থার আগেও আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণেই বিএনপিকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। সেই আন্দোলনসহ জরুরি অবস্থার সময়ের ছাত্র আন্দোলনের সুফল আওয়ামী লীগের ঘরেই গিয়েছিল ২০০৮-এর শেষের নির্বাচনে। নব্বইয়ের পরের এসব আন্দোলনে যারা জয়ী হয়েছে, তাদের দাবি মোতাবেকই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। সেটাই তাদের নির্বাচনী বিজয়ের জন্য অনুকূল ও ‘নিরপেক্ষ’ পরিবেশ দিয়েছে। তাই এককথায় বলা যায়, বড় গণ-আন্দোলন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনও যেমন হওয়ার নয়, তেমনি বিএনপির পক্ষেও আবার ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। আবার বড় কোনো আন্দোলনের আবহ তৈরির তাকদও দলটির আছে বলে মনে হয় না। নিজেদের ভুলের পর ভুল এবং সরকারি দমন-পীড়নে জেরবার অবস্থায় তাদের অবস্থা অনেকটা নিয়তিবাদীর মতো। ভবিষ্যতে কেউ এসে তাদের উদ্ধার করবে এমন আশা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না।
বিদায়ী সিইসি সম্ভবত এসব জানেন। গত মঙ্গলবার সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিদায়ী শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রথা অনুযায়ী কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। কথা বলবার সময় চিন্তা না করলেও চলে, কিন্তু নীরব অবস্থায় মাথায় চিন্তা আসেই। তিনি কি ভাবছিলেন সাবেক বিতর্কিত সিইসি এম এ আজিজের নামের পাশে তাঁর নামও কৌতুক আর পরিহাসের সঙ্গে উচ্চারিত হবে? তিনি যে চিন্তা করে কথা বলেন না তাঁর প্রমাণও রেখেছেন শেষ সংবাদ সম্মেলনে। সাংবাদিকদের কাছে তিনি গর্বের সঙ্গে বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন তাঁদের কমিশনের মতোই হবে। কথাটা নতুন সিইসি ও সরকারের জন্য অবশ্যই বিব্রতকর। নতুন নির্বাচন কমিশনের চরিত্র কী হবে, তা কাজী সাহেব প্রথম প্রহরে কীভাবে জানলেন? তিনি কি এমন কিছু জানেন, যা আমরা সাধারণ মানুষ জানি না?
এরপর আর কিছু বলার থাকতে পারে না। প্রবাদ আছে, ডাক্তারের সঙ্গে তর্ক কোরো না, কারণ তাঁর কাছে ভেতরের তথ্য রয়েছে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothom-alo.info