ড. জয়া সেনগুপ্তার কাছে খোলা চিঠিঃ সুজাত মনসুর
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৫৫:১৮,অপরাহ্ন ০২ মার্চ ২০১৭ | সংবাদটি ১৩৫৫ বার পঠিত
প্রিয় বৌদি
দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রাপ্তি পর্যন্ত অনেকেই আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। একটু দেরিতে হলেও আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেননা, শিক্ষিত, মার্জিত, সজ্জন হিসেবে আপনি বরাবরই আমার একজন প্রিয় মানুষ। যদিও আপনার সাথে আমার দেখা সাক্ষাত হয়েছে খুবই কম। কিন্তু কখনোই ভালবাসা কিংবা স্নেহের কমতি ছিল না। সেই আপনি যখন কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ করেই, নানা কারনে আলোচিত-সমালোচিত বাংলাদেশের রাজনীতির এক কিংবদন্তি, কথার যাদুঘর বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর শুন্য আসনটিতে মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে পারলেন, তাতে আশ্চর্য হলেও অবাক হইনি। কেননা, বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে যেভাবে উত্তরসুরিদের সংসদে অভিসিক্ত করার রেয়াজ চালু হয়েছে তাতে আপনার মনোনয়ন প্রাপ্তি অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। শুধু ব্যতিক্রম দেখলাম বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক কিংবদন্তি, যিনি সিলেট অঞ্চলে অভিজাত শ্রেনীর বৈঠকখানা থেকে রাজনীতিকে গণ-মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছিলেন, জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের মৃত্যুতে শুন্য হওয়া আসনে। তাঁর বড় ছেলে আজিজুস সামাদ আজাদ ডন বারবার মনোনয়ন চেয়েও পায় না। অথচ জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি যে কম যান না, তা প্রমান করেছেন গত সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতা করে। শোনা যায় তাঁকে নাকি ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করা হয়েছে।
জয়া বৌদি
আপনি যে দলীয় মনোনয়ন পাবেন এবং অতি সহজেই সাংসদ নির্বাচিত হবেন তাতে কোন সন্দেহ আমার ছিল না। এমনকি বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায়ও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন, লক্ষন দেখে তাই মনে হচ্ছে। তবে মনোনয়ন প্রাপ্তির বিষয়টিতে নিঃসন্দেহ হবার যুক্তি হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, যারা পিতৃহারা কিংবা স্বামীহারা হন তাদের প্রতি একটু সহানুভুতির মনোভাব পোষণ করেন বরাবরই। হয়তো তাঁর মনে তখন পনেরোই আগস্টের কালোরাতে পিতা-মাতা-ভাই-স্বজনদের মৃত্যু দৃশ্যটি মনে পড়ে যায়। এছাড়া আপনাদের পরিবারের প্রতি কেন জানি তাঁর অন্তরে আলাদা একটা সহানুভুতির জায়গা রক্ষিত রয়েছে। যদিও আপনার স্বামী, আমাদের ভাটি অঞ্চলের গর্ব প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের প্ররোচনায় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করার জন্য অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছিলেন, হয়েছিলেন সংস্কারবাদী। শুধু তাই নয়, যুগের পর যুগ সাংসদ হওয়া সত্বেও মন্ত্রীত্ব না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে যখন দাদা সেনগুপ্ত সরকারীদলের সাংসদ হওয়া সত্বেও সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেন, তখন তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্যই হোক অথবা শেষ বয়সে সান্তনা পুরষ্কার হিসেবে হোক, শেখ হাসিনা রেল মন্ত্রনালয় নামে আলাদা এক মন্ত্রনালয় গঠন করে তাঁকে রেল মন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ঘোষণা করলেন, রেল মন্ত্রনালয়ের দুর্নীতির কালো বিড়ালটি তিনি ধরতে চান। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই তিনি নিজেই কালো বিড়ালের তকমা গায়ে মেখে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। যদি, ঘটনার সত্যতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন। শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভা প্রথমবারের মত কালিমালিপ্ত হওয়া সত্বেও তিনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রাখলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। শুধু তাই নয়, আপনার এবং দাদার প্রতি শেখ হাসিনার যে একটা আলাদা সহানুভুতি আছে তার প্রমাণও পেয়েছিলাম ৮৬ সালের মাঝামাঝি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে, যখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা মধ্যরাতে ছুটে এসেছিলেন আপনার স্বামীর রাগ ভাঙিয়ে কেবিনের দরজা খোলার ব্যবস্থা করতে। তিনি সেদিন আপনার অশ্রুসজল চোখ দেখেও ঘুমুতে যেতে পারেননি। এ ঘটনার স্বাক্ষী আমি বিষয়টি বিস্তারিত অন্য লেখায় উল্লেখ করেছি।
দিরাই-শাল্লার ভবিষ্যৎ সাংসদ
আমি আপনার নির্বাচনী এলাকার একজন নাগরিক, বর্তমানে বিলেত প্রবাসী। এক সময় দিরাই-শাল্লার রাজনীতিতে সরব পদচারণা ছিল, বিশেষ করে আশির দশকের শেষভাগে। সেই সময়ই আপনার সাথে পরিচয় হয় আমার। মনে আছে, ৭৯ সালের নির্বাচনে আপনার স্বামী যখন দিরাই-শাল্লা-জামালগঞ্জের আওয়ামী লীগ-নেতাকর্মীদের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে দোয়াত-কলম প্রতিকে জয়ী হয়েছিলেন, তখন যে গোটা কয়জন নৌকার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আমিও ছিলাম। তখন স্কুলে পড়ি। নির্বাচনের কয়েকদিন পর একদিন সকালবেলা হঠাৎ দেখি আপনি আমাদের উঠানে দাঁড়িয়ে, সাথে দুওজের(দিরাই বাজার সংলগ্ন পাড়া) মিরাদি। আশ্চর্য আর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি? উত্তরে বললেন, আমাকে দেখতে এসেছেন। অভিভুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ আর আপনি সেনদার স্ত্রী, আমাদের জয়া বৌদি। আমার অবাক হওয়া দেখে আপনি বলেছিলেন, যে ছোট্ট্ মানুষটি অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে উল্টোস্রোতে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করে তাকে দেখার কৌতুহল মিটাতেই তিনি চলে এসেছেন। ঘটনাটি হয়তো আপনার মনে নেই কিন্তু আমার আজীবন মনে থাকবে। এটা আমার জীবনের একটি অতি প্রিয় স্মৃতি, অনুভুতি। তারপর যতবার আপনার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় অথবা ঝিগাতলায় বাসায় গিয়েছি, ভেতরের ঘরে ডেকে নিয়ে আদর-আপ্যায়ন করেছেন। সেই পুরনো স্মৃতির দাবি নিয়ে এবং দিরাই-শাল্লার রাজনীতির আলোকিত সময়ের একজন রাজপথের কর্মী হিসেবে তাই কিছু প্রত্যাশা নিয়ে এই খোলা চিঠিখানা লিখছি। জানিনা, আপনার নজরে পড়বে কি না, যদি পড়ে তাহলে আশা করি এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি দেবেন দিরাই-শাল্লাবাসী এবং আপনার ভবিষ্যত রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সুবিধার জন্য।
দিরাই-শাল্লা এক সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিল। সেখানে নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হত। নাটক-যাত্রা-পালাগান হত। ছিল প্রগতিশীল রাজনীতির বিদ্যাপীঠ। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসের কোন স্থান ছিল না। কিন্তু আজ আর সেই আলোকিত দিরাই-শাল্লা নেই। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চারিদিকে। নেই আগের মত সামাজিক বন্ধন। নেই সাহিত্য-সংস্কৃতি কিংবা নাটক, যাত্রা-পালাগানের উৎসব। সুস্থ ও প্রগতিশীল রাজনীতিকে বিতাড়িত করেছে দৃর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাস। দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে শুনেছি, জমি বিক্রি কিংবা কিনতে হলেও নাকি কোন কোন রথি-মহারথির অনুমতি লাগে। অতি সম্প্রতি দিরাই থানার হাতিয়া গ্রামে তিনটি খুনের ঘটনা ঘটেছে জলমহালকে কেন্দ্র করে। সেই খুনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা আদলতেই প্রমাণিত হবে। জনমনে আশংকা আপনার মনোনয়ন প্রাপ্তি এবং সাংসদ নির্বাচিত হবার মাধ্যমে দিরাইতে দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসের রাজনীতি আরো বেশি উৎসাহিত হবে। কেননা, যাদেরকে এ সবের জন্য দায়ি করা হয় তাদেরকে ইতোমধ্যেই আপনার আশে-পাশে দেখা গেছে। এটাও বাস্তবতা, আপনি ইচ্ছে করলেই রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলতে পারবেন না। এদের বলয় থেকে বের হয়ে আসাও কঠিন। কিন্তু চেষ্টা এবং ইচ্ছে থাকলে তা অসম্ভব কিছু নয়। সমাজে এখনো কিন্তু ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি। আপনি যদি জন-আকাংখ্যার পক্ষে দাঁড়ান তাহলে জনগনের সমর্থন আপনি অবশ্যই পাবেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর আপনাদের একমাত্র সন্তান সৌমেন সেনগুপ্ত বলেছিলেন, তিনি তার বাবার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন। আপনিও একই কথা বলেছেন। সেই অসমাপ্ত কাজ বলতে আপনি নিশ্চয় উন্নয়নের কথা বলেছেন। উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের সকল অঞ্চলেই কমবেশি হয়ে থাকে। আর তা করার দায়িত্ব এলাকার জনপ্রতিনিধির। সেই দায়িত্ব পালনের জন্যই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। সুতরাং এটা করা কোন বাহাদুরির বিষয় নয়। এগুলো হলো রুটিন কাজ। আমি মনেকরি আপনার স্বামীর অসমাপ্ত কাজ হলো দিরাই-শাল্লাকে দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্তি দেয়া। এ প্রসঙ্গে আপনার স্বামীর একটা আক্ষেপের কথা উল্লেখ করতে চাই, তাহলেই আপনি আমার কথার মর্ম অনুধাবণ করতে পারবেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে সুরঞ্জিত দা লন্ডন বেড়াতে এসেছিলেন। আমি তাঁর সাথে প্রায় সাড়ে তিনশ মাইল দুর থেকে ১১ বছর পর দেখা করতে গিয়েছিলাম। হোটেল রুমে যখন উনার সাথে কথা বলছিলাম তখন সাথে ছিল দিরাই উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল হোসেন চৌধুরী চান মিয়া। তিনি কথা প্রসঙ্গে আমাদেরকে বলেছিলেন, রাজনীতি এখন দুষিত হয়ে গেছে। দিরাই-শাল্লাও সেই দুষন থেকে রেহাই পায়নি। তিনি তা থেকে বের হয়ে আসতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। কারণ সেই রকম সময়, বয়স কিংবা নির্ভরযোগ্য আদর্শিক নেতাকর্মীও নেই।
আমরা দিরাই-শাল্লাবাসী মনেকরি রাজনৈতিক দুষণ দুরীকরণ হল তাঁর আসল অসমাপ্ত কাজ। আরেকটি বিষয় আপনার মনে রাখা প্রয়োজন। এবারের নির্বাচন কিন্তু আপনার জন্য এসিড টেস্ট, সেমি ফাইনাল। এবারের খেলায় তেমন কোন প্রতিদ্বন্ধিও নেই। আসল খেলা অর্থাৎ ফাইনাল খেলা আপনাকে খেলতে হবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে। সে সময় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্ধি হিসেবে যিনি আসতে পারেন তিনি হলেন নাসির উদ্দিন চৌধুরী। রাজনীতির খেলায় আপনি কিন্ত নবাগত আর নাসির চৌধুরী কিন্তু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আর্জেন্টিনার মেসি। সুতরাং নাসির চৌধুরীর বিপরীতে আপনাকে ফাইনাল খেলায় জিতে আসতে হলে, দিরাই-শাল্লাবাসীর মনে আপনার কাজের মাধ্যমে আশার আলো জাগাতে হবে। দিরাই-শাল্লাকে দুর্বৃত্তায়ন আর সন্ত্রাসের জনপদের বিপরীতে গড়ে তুলতে হবে আলোকিত জনপদরূপে। আরেকটি অপ্রিয় সত্য কথা বলতে চাই। আপনার মনোনয়ন প্রাপ্তিতে কিন্তু দিরাই-শাল্লার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খুশি হতে পারেনি, যদিও মেনে নিয়েছে। কেননা, তাদের মনে আশংকা, আবার বোধ হয় আপনার ঘাড়ে চড়ে দুর্বৃত্তরা দ্বিগুন উৎসাহে তাদের রাম রাজত্ব চালিয়ে যাবে। এই শংকিত জনগোষ্ঠির মন জয় করতে হলে আপনাকে দুষণমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে জনমনে স্বস্তি দিতে হবে। যা ছিল আপনার স্বামী অসমাপ্ত কাজ। আর তা যদি না করতে পারেন তাহলে আগামী নির্বাচনে যদি দিরাই-শাল্লার জনগন আপনাকে পত্রপাঠ বিদায় করে তাহলে আশ্চর্য কিংবা অবাক হবার কিছু থাকবে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের আর কিছুই করার থাকে না, সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। আপনি যদি আমাদের প্রত্যাশার আলোকিত দিরাই-শাল্লা উপহার দিতে পারেন তাহলে সাথী হতে আপত্তি নেই দিরাই-শাল্লার শংকিত-হতাশ জনগনের।
সুজাত মনসুরঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
email: suzatmansur@yahoo.com.