মানুষের আত্মিক উন্নতি আটকে আছে নীতিহীনতার চোরাবালিতে
প্রকাশিত হয়েছে : ২:১০:০০,অপরাহ্ন ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ | সংবাদটি ৬৭৭ বার পঠিত
রজত শুভ্র চক্রবর্তী, সহকারী অধ্যাপক দর্শন,
দ্বারিকা পাল মহিলা কলেজ শ্রীমঙ্গল।
বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষায় মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রিয় বন্ধুগণ। কিন্তু ইন্টারন্যাল পরীক্ষায় সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করার এত বড় সাজা কখনও শুনিনি। শাস্তি হিসেবে ঐ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করা যেতে পারে , পরীক্ষার্থীকে বহি:স্কার করাও যেতে পারে। তারপর আবার টি.সি দেয়া কেন ? পিতা-মাতা ক্ষমা চাওয়ার পরও তিরস্কার করে বের করে দেয়া হল শিক্ষার্থীকে । এই শিক্ষার্থী বেঁচে থাকলেও হয়তো বা কতিপয় প্রতিষ্ঠান প্রধানগণের এহেন আচরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন করেই একজন মানবিকতাবোধবর্জিত শিক্ষিকা হত। বাংলাদেশ সরকার যেখানে আনন্দের সাথে পাঠদানের সকল আয়োজন করতে বছরের শুরুতে বিনামূল্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বই দিচ্ছেন, প্রজেক্টর, কম্পিউটার ল্যাব, ডিজিটাল ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, প্রাথমিকে আবার স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে মিড-ডে মিলও সকল জায়গায় চালু করছেন , তখন অনাকাঙ্খিতভাবে কতিপয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এসব ঘটনা শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষাবান্ধব সরকারের এসব অর্জনকে ম্লান করে দেয় , আতঙ্কিত হয় আমাদের সন্তানেরা। এই সমাজে তথাকথিত ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য তৈরী করার জন্য দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত এরূপ কতিপয় বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কিন্তু কম দায়ী নয়। নাকের ডগায় বসে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের উচ্চবিত্তদের সন্তানদের পড়ানোর বদৌলতে অতিরিক্ত টিউশন ফি নিয়ে যাচ্ছে । আর আমাদের মত কিছু অভিভাবকরাও এসব প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছি। তাইতো তথাকথিত স্টেটাস মেইনটেইনের জন্য সমাজের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অভিভাবকেরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালান। কখনও বা দশ হাজার থেকে দু’তিন লাখ টাকা ডোনেশন দিয়েও ভর্তি করান।এতে করে লোভ বাড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীদের। আমাদের শিক্ষক সমাজকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর । আমার মত আপনিও নিজেকে প্রশ্ন করুন-এ জীবনে ক’জনকে মানবিকতার শিক্ষা দিতে পেরেছি আমরা ? গরীব মেহনতি মানুষের ব্যাংকে সঞ্চিত টাকা থেকে ঋন নিয়ে হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপীরা নির্লজ্জের মত নোংরা দাঁত বের করে হাসে , দেশের নীতি নির্ধারক হওয়ার জন্য নির্বাচন করে , কখনও বা মাধ্যমিক ফেল করা অঢেল কালো টাকার মালিকদের স্কুল-কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি বানিয়ে বসিয়ে দেয় মাষ্টার্স পাশ করা জীবন যুদ্ধে নিয়ত লিপ্ত প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী মানুষ গড়ার করিগরদের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য। এসব অনাচার দেখে দেশের জন্য ভাল কাজ করার স্বপ্নগুলো স্বপ্নেই থেকে যায় বাস্তবে রূপ নেয় না। আর্থিক উন্নতির ধান্ধায় পড়ে আত্মিক উন্নতির কথা ভুলে গিয়েছি আমরা, ভুলে গিয়েছি শিক্ষক হিসেবে আমাদের উপর জাতির ভবিষ্যত মানিবকবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ার দায়িত্বের কথা। তাইতো আমাদের মতই শিক্ষকদের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করে আমাদের শিক্ষক সমাজকে ব্যঙ্গ করে কিংবা অপমান করে কিছু মানুষরূপী অমানুষের দল , কোথাও আবার ৭ -৮ কিংবা শতেক মানুষ খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামী বেহায়ার মত ডান হাতের দু’আঙ্গুল দেখায় বিজয় চিহ্ন হিসেবে। আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি আত্মিক উন্নতি সাধনও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয় । তাই নৈতিক উন্নতি সাধনের শিক্ষা দিতে হবে , এরপর যারা এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষকতা করবে তারাও আমাদের সন্তানদের মানবিকতার পাঠদান করবে। একজন শিক্ষক হিসেবে এ ঘটনাটি আমাকেও লজ্জিত করেছে। আমাদের কথা বলা উচিৎ তাদের বিরুদ্ধে যারা মাধ্যমিক ফেল কিংবা পাশ করা লোককে হীন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কতিপয় স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটিতে সভাপতি বানিয়ে দিচ্ছেন কিংবা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই হচ্ছেন , সকল নাগরিকের জন্য অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে বণিজ্যিকীকরণ করছেন, বছর বছর টিউশন ফি বাড়াচ্ছেন , ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে অনেক টাকা ডোনেশন নিচ্ছেন , ডোনেশনের প্রাপ্ত অর্থের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে শিক্ষকদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছেন কিংবা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ তৈরী করছেন। প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসক , প্রকৌশলী , শিক্ষক , আইনজীবী ও নানা রকম পেশাজীবী তৈরী হয়ে বের হচ্ছেন কিন্তু দেশ গড়ার কারিগর সত্যিকার মানবিকতাবোধসম্পন শিক্ষায় শিক্ষিত এসব পেশাজীবীদের ক’জন বের হচ্ছেন? এখনই সময় শিরদাড়া সোজা করে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করার , নয়তো কতিপয় ব্যক্তির নীতিহীনতার চোরাবালিতে অকালে ডুবে মরবে আমাদের স্বপ্ন সফল করার কারিগর আমাদের সযত্নে লালিত-পালিত সোনামনিরা।