মাজারই যাদের ঘরবাড়ি
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২০:০৭,অপরাহ্ন ২৪ আগস্ট ২০১৫ | সংবাদটি ৩০২ বার পঠিত
স্টাফ রিপোর্টার,
দিলশাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বয়স আনুমানিক ৬০। দু’ছেলে আয়-রোজগার করে। কিন্তু এসব তাকে টানে না। মাঝে মাঝে বাড়িতে গেলেও ১০ দিনের বেশি থাকতে পারেন না। অজানা এক আকর্ষণে আবার ফিরে আসেন মাজারে। এক বেলা খাবার নিশ্চিত। বাকি দু’বেলা কখনও খান, কখনও খান না।
রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলীর মাজার। দিলশাদের মতো হাজার মানুষের লোকসমাগম ঘটে এই মাজারে। প্রতিদিনই মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে মানোবাসনা পূরণ করতে মানত করতে আসেন। কেউ একদিন, কেউ দুই-তিন দিন অবস্থান করেন। আর দিলশাদের মতো মানুষেরা দিনের পর দিন অবস্থান করেন। মাজারকেই ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন তারা। দিলশাদের মতো মাজারে থাকা হাজারও মানুষের প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে আলাদা গল্প। তেমনই একজন সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার জামালপুর গ্রামের ইরন আলী। ৪০ বছর ধরে তিনি মাজারে আসা-যাওয়া করেন। ৫৫ বছরের ইরন আলী জীবনের বেশির ভাগ সময় মিরপুর মাজারে কাটালেও দেশের ভেতর এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন মাজারে ঘুরেন মাঝে মাঝেই। তবে সীমানা পার হতে তার ভিসা পাসপোর্ট লাগে না। আবার জন্ম থেকে মাজারেই বেড়ে ওঠে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন অনেকে। মাজারই তাদের পৃথিবী।
বৃস্পতিবার বিকালে মাজারে কথা হয় দিলশাদ ও ইরন আলীর সঙ্গে। তারা জানান, তাদের জীবনের নানা অধ্যায়। সিরাজগঞ্জের দিলশাদ জানান, মায়ের গর্ভে থাকতেই তার চাচাতো বোন মাকে বলেছিল চাচি তোমার দিলশাদ আসছে। তাই জন্মের পর ওই নামই রাখা হয়। বলেন, নামটা তার রাজকীয় হলেও কপালের ফেরে আজ তিনি পথে পথে। তিন বছর ধরে পড়ে আছেন মাজারে। স্মৃতিচারণ করে বলেন, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কাওয়াকোলায় বাড়ি ছিল তাদের। বাবা ছিলেন গেরস্ত। জামি-জমা ছিল। কিন্তু নদীভাঙনে এক সময় ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। যেটুকু বাকি ছিল পেটের ভাত যোগাতে বাবা বিক্রি করে দেয়। এক সময় ভূমিহীন হয়ে চলে আসেন সিরাজগঞ্জ শহরে। বর্তমান সিরাজগঞ্জ শহরের ওয়াপদার ভেতরে সরকারি জায়গায় দুই ছেলে ও তাদের সংসার নিয়ে বসবাস। ছোট বেলায় ভূমিহীন হয়ে পড়ায় শহরে এসে লক্ষ্মী সিনেমা হলের সামনে একটি চায়ের দোকানে কাজ নেন। সময়টা না বলতে পারলেও তিনি জানান, তখন আইয়ুবের আমল ছিল। দোকানে তার কোন মজুরি ছিল না। সিনেমা হলে চা বয়ে দেয়ার বিনিময়ে যে বকশিশ দিতো তা তার জন্য যথেষ্ট ছিল। সারাদিনে ৪ আনা জুটতো। তাই নিয়ে বেশ খুশি থাকতেন। আর থাকা-খাওয়া ছিল মালিকের অধীনে। এরপর সময় গড়িয়ে যায়, বিয়ে করেন। বিভিন্ন জায়গায় দিন মজুরের কাজ করেন। দিলশাদ বলেন, জিয়ার আমলে ঢাকায় এসে সদরঘাটে দিনমজুরের কাজ করতেন। তখনই একদিন এই মাজারে আসেন বেড়াতে। এরপর আর মাজারে আসেননি। এরশাদের আমলে ফরিদপুরে একটি চায়ের দোকান দেন। গত তিন বছর ধরে তিনি এই মাজারে। তবে এর পেছনেও রয়েছে তার জীবনের করুণ গল্প। ৪ বছর আগে একদিন সারাদিন দোকান করে রাতে বাইসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় পেছন থেকে একটি ট্রাক এসে তার বাম পায়ের ওপর তুলে দেয়। হাঁটুর নিচ থেকে সম্পূর্ণ থেতলে যায়। পরে একবছর ট্রিটমেন্ট করে কোনরকম সুস্থ হন। কিন্তু পা ভাঁজ করতে পারেন না। কোন কাজও করতে পারেন না। তাই চলে এসেছেন এই মাজারে। এখানে এক বেলা খেতে দেয় মাজার কর্তৃপক্ষ। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে মানুষ এসে তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যান। সেদিন বেশ তৃপ্তি ভরে খান। তার দুই ছেলে ইটের মওসুমে ইট ভাটায় কাজ করে। আর বছরের অন্য সময় সিলেটে গিয়ে পাথরের কাজ করে। মাঝে মাঝে বাড়ি যান দিলশাদ, কিন্তু ১০দিনের বেশি থাকতে পারেন না। বলেন, এখানে তার অনেক মানুষ পরিচিত হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে সময় কাটে। তাদের টানে ছুটে আসেন। নিজে কাজ করতে পারেন না, খাবারও জুটে যায়। মাজারে আসলে ধর্মের কাজও হয়। রাতে মাজারের পাশে ফুটপাতে রাত কাটান। দিলশাদ সমালোচনা করে বলেন, এখানে অনেক ভণ্ডও আছে। তারা মানুষকে ধোঁকা দেয়। কৌশলে টাকা পয়সা বাগিয়ে নেয়।
বালাগঞ্জের ইরন আলী বলেন, ১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি এই মাজারে আসা-যাওয়া করেন। এখন তার বয়স ৫৫। এক সময় প্রচুর সহায় সম্পত্তি ছিল তাদের। এখন কিছুই নেই। এজন্য কাউকে দায়ী করেন না। নিজেকেই দূষেণ তিনি। ছোট বেলা থেকেই বাউণ্ডেলে ছিলেন। কাজ না করায় খরচ যোগাতে তাই বিভিন্ন সময় জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন। বলেন, যে জমি ২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তার দাম এখন দুই লাখ টাকা। প্রতিবেশী কৌশলে এসব জমি নিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে জানান, নাহ! তারা বরং নিতে চাইতো না। আমি জোর করে ধার নিতাম। বলতাম ধার শোধ না করতে পারলে ওমুক জমিটা দিয়ে দেব। তারা আমার জোরাজুরিতে দিতে বাধ্য হতো। সংগ্রামের (মুক্তিযুদ্ধ) পর তিনি বাড়ি ছাড়েন। ২০ বছর বয়সে বিয়ে করেন আপন মামাতো বোনকে। কিন্তু তারপরও ঘরমুখো হতে পারেননি। এরই মধ্যে এক ছেলে সন্তান ও মেয়ে সন্তানের বাবা হয়েছেন তিনি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে দুই বিয়ে করেছে। এজন্য তিনি ছেলেকে পছন্দ করেন না বলেও জানান। তিনি জানান, তার স্ত্রীই ছেলে মেয়েকে বড় করেছেন। তিনি সিলেটের একটি হাসপাতালে কাজ করেন। ৫ হাজার টাকা বেতন পান। সিলেটের বাগবাগিতে বাসা ভাড়া করে থাকেন। তাকেও মাঝে মাঝে দুই একশ’ টাকা দেন। তবে ছেলের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেন না। তিনি বলেন, তার সহপাঠী যিনি ক্লাসে তার পাশেই বসতেন তিনি এখন বড় উকিল। দেখা হলে সে বলে- তুমি গরম ভাত খেয়ে স্কুলে আসতে আর আমি আটা রুটি খেয়ে আসতাম। কর্মফলে আজ তুমি পথে পথে। ইরন আলী বলেন, তিনি শুধু এই মাজারেই না। চট্টগ্রামে বিভিন্ন মাজারে যান। দেশের বিভিন্ন মাজারে ঘুরেন। ভারতের আজমির শরীফও যান। ভিসা পাসপোর্ট লাগে না। প্রথমে বিজিবি আটকায়। পরে জোরাজুরিতে ছেড়ে দেয়। ওপার যাওয়ার পর বিএসএফ আটকায়। মাজারে যাওয়ার কথা বললে বসিয়ে রাখে। এর মধ্যে দু’একজন ইশারা দিয়ে যেতে বলেন। বাসেও অনেক সময় টাকা নেই বলে ফ্রি যাতায়াত করেন। নিজের ভাগ্য এবং কর্মফলকে দায়ী করলেও ইরন আলীর একটি ক্ষোভ রয়েছে। বলেন, সংগ্রামের বছর মুক্তিযুদ্ধ না করলেও পক্ষে অনেক কাজ করেছি। রাস্তা কেটে, পাথর দিয়ে খান সেনাদের চলাচলে বাধা দিয়েছি। তার এলাকার কমিশনার তাকে ভাতা দিবে বলেছিল। কিন্তু বললেই তালবাহানা করে।
তিন সাগরেদকে সঙ্গে করে গাছতলায় বসে বই পড়ছিলেন মোহাম্মদ সাগর। বাচ্চাদের নামের বই। সুদূর ভারতের আজমীর শরীফ থেকে পায়ে হেঁটে সঙ্গীদের নিয়ে শাহ আলীর মাজারে এসেছেন তিনি। জানালেন, শাহ আলী বাবার টানে এখানে এসেছেন। পথে কোন বাধাই তাদের আটকাতে পারেনি। চল্লিশোর্ধ্ব সাগরের বাড়ি নোয়াখালী। ছোটবেলা থেকে মাজারে মাজারে ঘুরছেন। মাজারে ঘোরার কারণ সম্পর্কে সাগরের বক্তব্য হচ্ছে, শান্তি খোঁজা। ঘরের শান্তি আসল শান্তি না। তার সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলে বলেন, আগে ঘরে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। এরপর নিজের ভেতরে ভাব আনতে হবে। তার ভাষায়, আমরা যেভাবে ভাবি আপনারা সেভাবে ভাবেন না। সুতরাং আপনাদের এত সহজে ভাব আসবে না। সাগর জানান, এখানে কতদিন অবস্থান করবেন তা অনিশ্চিত। বাবার সিগন্যাল পেলে পরে এখান থেকে সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে যাবেন। সেখানে হেঁটে যেতে ৫ দিন সময় লাগবে বলে জানান তিনি। মাজারের এই অতিথিদের সামনে দুুপুরের খাবার নিয়ে আসেন একজন খাদেম। গরুর মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি। পলিথিনে মোড়ানো খিচুড়ি সঙ্গীদের নিয়ে খাওয়া শুরু করেন সাগর।
শাহ আলীর মাজারে বাবার কাছ থেকে পাওনা নিতে এসেছেন টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ শামছু পাগলা। বয়স পঞ্চাশের কোটায়। গায়ে ময়লা গামছা। মাথায় কালো কাপড় বাঁধা। মাজারের মসজিদের জুতার ঘর পাহারা দিচ্ছিলেন তিনি। শামছু পাগলা নিজেই একটি মাজার চালান। তার দাবি, শাহ চিশতী (রহ:)-এর মাজারের খাদেম তিনি। এখানে এসেছেন বাবার কাছে ‘পাওনা’ নিতে। ঈদের আগে এসেছেন। কতদিন থাকবেন বলতে পারেন না। বাবা কি দেবেন- জানতে চাইলে বলেন সবকিছুই দিতে পারেন বাবা। শামছুর কাছে দোয়া চাইলে বলেন, আমি দেওয়ার কেউ না। সব দেয়ার মালিক বাবা। তার কাছে চান। তিনি সবার মন জানেন। শামছু পাগলা জানান, মাজারে তাকে দিনে একবেলা খেতে দেয়া হয়। রাত দশটার পর বাইরের কেউ মাজারে অবস্থান করতে পারেন না। বিশেষ অতিথি হওয়ার কারণে রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে তার। বাবার কাছে পাওনা বরাদ্দ পেলেই তবে এলাকায় ফিরে যাবেন বলে জানান তিনি।
হাইকোর্ট মাজারের পাশে সংসার পাতা হাওয়া বেগম (৫০) জানান, কিশোরগঞ্জে তাড়াইলের তালজাঙ্গা গ্রাম থেকে স্বামী সেলিম মিয়ার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন অনেকদিন আগে। তবে স্বপ্নের এই শহরে আসা সুখকর হয়নি তার জন্য। তিনি জানান, ঢাকায় আসার পরপরই ইয়াসিন (৫ বছর) ও বেলায়েত (১ বছর) নামে দুই ছেলে হাইকোর্ট এলাকা থেকে হারিয়ে যায়। স্বামী সেলিম মিয়াও মারা যান এর কিছুদিন পরেই। এখন একমাত্র ছেলে জুনায়েদকে নিয়ে তার সংসার। এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের গাড়ি ঠেলে যা পান তা দিয়ে কোনমতে দিন চলে যায় হাওয়া বেগমের। তবে, দুপুরে খাওয়ার অভাব পূরণ হয় মাজারের শিন্নিতে। হাওয়া বেগম বলেন, ওখানে প্রতিদিন ফকিরদের জন্য রান্না হয়। দুপুরে অনেকের সঙ্গে তিনিও ছেলেক নিয়ে ওখান থেকে খান। আবার বিশেষ দিনে অনেকেই দান খয়রাত করতে আসেন। তখন কিছু পাওয়া যায়। প্রতিবন্ধী ইদ্রিস (৫৫) জানান, ১০ বছর ধরে হাইকোর্ট মাজার এলাকায় বাস করছেন তিনি। পুলিশি ঝামেলা ছাড়া অন্য কোন সমস্যা এখনো হয়নি। যতদিন জীবিত আছেন এখানেই কাটিয়ে দেবেন। হাইকোর্ট মাজরের খাদেম নুরুল হক বলেন, প্রতিদিন এই মাজারে দুপুরে শিন্নির আয়োজন থাকে। কোনদিন খিচুড়ি, তেহারি। আবার কোনদিন বিরিয়ানি। ঢাকা শহেরর বিশিষ্টজনদের দানের টাকায় এসব রান্না হয়। তিনি বলেন, হাইকোর্ট মাজার এলাকায় শত শত উদ্বাস্তু ফুটপাতে বসবাস করে। এদের অনেকেই দুপুরের আহারের জন্য মাজারে চলে অসে। প্রতিদিন মাজারে অন্তত ২শ’ থেকে ৩শ’ লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। বিশেষ দিনে তা ৫শ’ ছাড়িয়ে যায়। যাদের প্রায় সবাই এই এলাকার ফুটপাতের বাসিন্দা। এমনকি যাত্রবাড়ী, গুলিস্তান, মতিঝিল থেকেও ফকির মিসকিনরা হাইকোর্টের মাজারে চলে আসেন দুপুরে খাওয়ার জন্য।