১৩ ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসে থাকা সিরীয় শরণার্থীকে বাঁচালেন গ্রীক নারী
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩৫:৪২,অপরাহ্ন ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | সংবাদটি ৫০৫ বার পঠিত
স্টাফ রিপোর্টার,
গ্রিসের সাবেক মডেল ও অভিনেত্রী স্যান্ড্রা সিলিগেরিডু। বন্ধু-পরিবারসহ কোস দ্বিপে গিয়েছিলেন অবকাশ যাপনে। গত বৃহস্পতিবার দ্বীপে ফেরার পথে সমুদ্রের ওপর কিছু একটা চোখে পড়ে তার। এজিয়ান সমুদ্রের গভীর নীল পানির মধ্য থেকে এক জোড়া হাত নাড়ছিল কেউ তার উদ্দেশে। স্যান্ড্রার স্বামী দিমিত্রি নৌকার নিয়ন্ত্রণ বাম দিকে ঘুরিয়ে দিলেন অজ্ঞাত ওই মানুষটিকে এড়িয়ে যাবার জন্য। সমুদ্রে অযাচিত কোন ঝামেলায় পড়তে চাননি তিনি। কিন্তু যতই কাছে যান, স্যান্ড্রা উপলব্ধি করলেন খুব মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করছিলেন তারা। চিৎকার করে দিমিত্রিকে বললেন নৌকা ঘুরাতে। তারা যা দেখলেন তা হয়তো তাদের স্মৃতিতে দাগ কেটে থাকবে চিরদিন। পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল অর্ধ-সচেতন এক ব্যক্তি। প্রানান্ত চেষ্টায় কোনমতে আকড়ে ধরে আছে তার লাইফ-জ্যাকেট। সিএনএনকে স্যান্ড্রা বলেন, ঢেউগুলো ছিল প্রকা-। আমরা কাছে গিয়ে দেখি একজন মানুষ ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে রয়েছে। হঠাৎই নিজের ভেতর সঞ্চারিত মানবতার উদ্যোমে অনুপ্রাণিত হলেন স্যান্ড্রা। বড় ঢেউয়ের ভয়কে জয় করে নৌকায় কিনারে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন মানুষটিকে বাঁচাবার জন্য। শক্ত হাতে লোকটির হাত ধরলেন স্যান্ড্রা। আর তার বন্ধুরা লোকটিকে সমুদ্র থেকে নৌকায় টেনে তুলতে সাহায্য করলেন। সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করে স্যান্ড্রা বলেন, লোকটি এতো দূর্বল ছিল যে হাঁটা তো দূরে থাক দাড়াতেও পারছিল না। শুধুমাত্র একটা কথাই সে বলতে পেরেছিল যে সে সিরিয়া থেকে এসেছে। পরে সে জানায় তার নাম মোহম্মদ বেসমার। ১৩ ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসেছিল সে। উদ্ধার করার পরপরই স্যান্ড্রা গ্রিক কোস্ট গার্ডকে ঘটনাটি অবহিত করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বিভিষিকা থেকে বাচতে গ্রিসে যেতে চেয়েছিলেন বেসমার। আরও ৩৯ সিরীয় শরণার্থীর সঙ্গে তুরস্কের একটি সমুদ্রসৈকত থেকে ছোট একটি নৌকায় যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্প সময় পরই বিপদে পড়ে যান তারা। নৌকার একটি বৈঠা সমুদ্রে পড়ে যায়। বেসমার তখন নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সমুদ্রে ঝাপ দেন বৈঠাটি উদ্ধার করতে। নৌকার অনেক যাত্রী ছিল অসুস্থ। তাদের জীবনা বাচানো নিশ্চিত করতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেন বেসমার। স্যান্ড্রা বলেন, সে ছিল নৌকার সবার থেকে সাহসী। তারা যেন সবাই গ্রিসে পৌছুতে পারেন সে জন্য বৈঠাটি উদ্ধার করতে সমুদ্রে ঝাপ দেয় সে। কিন্তু প্রচ- স্রোত আর প্রকা- ঢেউয়ের তোড়ে নৌকায় ফিরে আসতে পারেন নি তিনি। নৌকার যাত্রীরা শেষমুহুর্তে শুধুমাত্র তার দিকে একটি লাইফজ্যাকেট ছুড়ে দিতে পেরেছিল। এরপর সমুদ্রের মধ্যে তাদের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায় মোহম্মদ বেসমার। অজানার উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রণহীন ভাসতে থাকেন তিনি। এভাবে ১৩ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তিনি। ওই লাইফজ্যাকেটের বদৌলতে বেঁচে ছিলেন কোন মতে। আশপাশ দিয়ে অনেক নৌকা পার হয়ে গেছে কিন্তু চিৎকার করে ডাকার শক্তি ছিল তা তার। নৌকাগুলোর আরোহীরা তাকে আদৌ দেখতে পেরেছিল কিনা তাও বোঝার উপায় ছিল তা বেসমারের। একপর্যায়ে বোধশক্তি লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়। কোস দ্বীপে কোস্টগার্ডের এক কর্মকর্তা বেসমারের এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি সিএনএনকে জানান, বেসমার যেই নৌকায় ছিল তা তীরে পৌছাতে পেরেছিল। আর তার ঘটনা জানার পর উদ্ধার অভিযানও চালানো হয়েছিল। এছাড়া বিস্তারিত কিছু জানাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। স্যান্ড্রা ও তার বন্ধুরা বেসমারকে যখন উদ্ধার করেন ততক্ষণে জ্ঞান অর্ধেক হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। স্যান্ড্রা বলেন, সে কাঁপছিল আর শরীরের তাপপাত্রা অনেক কমে গিয়েছিল (হাইপোথার্মিয়া)। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে আমার স্বামী একজন ডাক্তার হওয়ায় তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পেরেছিলেন। নৌকায় ওঠানোর পরপরই আমি তার শরীরে তোয়ালে পেঁচিয়ে দেই। তাকে জড়িয়ে ধরি। তাকে যতটা সম্ভব উষ্ণ রাখা সব রকম চেষ্টা করি। এরপর এক পর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন স্যান্ড্রা। বেসমারের দূর্দশা তাকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে কেদে ফেলেন তিনি। স্যান্ড্রা বলেন, পুরো সময়টা আমি কাঁদছিলাম। যে মুহুর্তে আমি ওই মানুষটিকে সমুদ্রের পানিতে দেখি তখন থেকে আমার আত্মা এতো বেশি দুখ:ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে যে আমার অনুভূতি হয় আমি যেন তার জায়গাতে আছি। ওই মুহুর্তে আমার ভাবনায় আসেনি আমরা যা করছি তা বিপজ্জনক কিনা। বৈধ, অবৈধ কিনা। একটি মানবাত্মা বিপদে ছিল। আর ওই মানুষটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করাটা ছিল আমার কাছে সবথেকে স্বাভাবিক একটা সিদ্ধান্ত। বেসমারকে তীরে আনার পর তার কাছ থেকে বিদায় নেন স্যান্ড্রা ও তার পরিবার বন্ধুজনেরা। পরদিন ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন স্যান্ড্রা। এতে দেখা যায় উদ্ধারের পর পরম স্নেহে বেসমারকে জড়িয়ে রেখেছেন তিনি। ছবিটি মুহুর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। স্যান্ড্রার কাছে ওই ছবিটি ভালোবাসার এক মর্মভেদী প্রমান। স্যান্ড্রা বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য ছিল। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। নিসন্দেহে এ ঘটনার পর আমার জীবন পাল্টে গেছে। আমি কিছু বিষয় উপলব্ধি করেছি। এর আগে গ্রীসে আমরা এ পরিস্থিতি নিয়ে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ ছিলাম। আমাদের ক্ষোভ ছিল যে এসব মানুষদের সাহায্য করার জন্য কোন সংস্থা, কোন রাষ্ট্র বা কোন সামাজিক নিয়ম কানুন নেই। এরা নিরপরাধ মানবাত্মা। তারা ভুল কিছু করে নি। তারা শুধু তাদের পরিবারকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। নিজেদের আর তাদের সন্তানদের সলিল সমাধি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যা ঘটছে তা অত্যন্ত মর্মান্তিক।’ বেসমার স্যান্ড্রাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। গ্রিসে পৌছানোর জন্য তার জীবনের ঝুঁকি নেয়া সিদ্ধান্তের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা হৃদয়বিদারক। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া থেকে আমাকে বাচাতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানানোর আগে আমি গ্রিক সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাই। কেননা আমি দেশটিতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছি। কিন্তু আমার দেশ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের নরক থেকে পালিয়ে বাঁচার অন্য কোন সমাধান আমি পাইনি। বেসমারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন স্যান্ড্রা। বেসমার তাকে বলেছেন, আর ১০-১৫ মিনিট দেরি হলে সে মারা যেতো। এ সপ্তাহে এথেন্সে আবারও তারা দেখা করার পরিকল্পনা করেছেন। ইউরোপের অভিবাসী সঙ্কট যখন চুড়ান্ত মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে তখন একটি জীবন বাঁচাতে স্যান্ড্রার অসামান্য মানবিক অবদান আনন্দঅশ্রুর খোরাক যোগায়। সমুদ্রতীরে সিরীয় শিশু আয়লানের নিথর মৃতদেহের ছবি যখন মানবজাতির বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করছে তখন একজন স্যান্ড্রার কির্তী আশাবাদী হওয়ার সাহস যোগায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এ বছর এখন পর্যন্ত ৩ লক্ষাধিক শরনার্থী ও অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পার করে ইউরোপে পালিয়েছে। বেশিরভাগই এসেছে সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে। এদের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আশ্রয় নিয়েছে গ্রিসে। আয়লান কুর্দির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বৃহস্পতিবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান বলেন, তিনি ও তার পরিবার শোকস্তব্ধ। শরণার্থীদের দূর্দশাকে কার্যকরভাবে মোকাবোলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি পুরো পশ্চিমা বিশ্বকে দোষারোপ করেছেন। আর ইউরোপ এখন এ শরণার্থী সঙ্কট যেভাবে মোকাবেলা করছে তা নিয়ে স্যান্ড্র্যাও তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ইউরোপ হাত পা গুটিয়ে বসে আছে আর টিভিতে সংবাদ দেখছে। আমার বিশ্বাস ব্যপক পরিসরে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিন সন্তানের মা স্যান্ড্র্যা বেসমারের জীবন বাঁচানোর ঘটনা নিয়ে বলেন, সহানুভূতি দেখানোর একটি পদক্ষেপ এতো বেশি সমর্থন নিয়ে আসবে তা কখনও কল্পনাও করিনি। আমি বিশ্বাস করি যে কেউটি একই কাজ করতো যদি তারা নিজেদের মানুষ বলতে চায়।