রাস্তায় অপেক্ষমাণ হজযাত্রীরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৪৬:০২,অপরাহ্ন ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | সংবাদটি ৩১৬ বার পঠিত
কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা গ্রামের ৭৫ বছরের বৃদ্ধ আরশ আলী। শেষ বয়সে পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরব যাওয়ার জন্য একটি এজেন্সির মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারবেন কিনা এমন অনিশ্চয়তায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। শুধু আরশ আলী-ই নন, হজযাত্রা ঝুলে গেছে তার মতো বৈধ প্রায় ৫ হাজার হজ গমনেচ্ছু মানুষের। আর কখনও হজ পাবেন কিনা সে আশঙ্কা কুরে কুরে খাচ্ছে তাদের। তাই এবারেই হজযাত্রা নিশ্চিত করতে অবশেষে ফুটপাতে অবস্থান নিয়েছেন তারা। গতকাল আশকোনা হজ ক্যাম্পের সামনে ফুটপাতে অবস্থান নেয় কোটা বঞ্চিত এজেন্সির মালিক ও অপেক্ষায় থাকা ৫ শতাধিক ব্যক্তি। তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে উদ্বুদ্ধ এ পরিস্থিতিতে হজ অফিসের সহকারী হজ অফিসার আবদুল মালেককে স্ট্যান্ড রিলিজ দেয়া হয়েছে। হজ অফিসের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এবারের হজ মওসুমের শুরুতেই ধর্মমন্ত্রণালয় ও হজ অফিসের কর্মকর্তা এবং হাব নেতাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ডাটাবেজে ১০ হাজারেরও বেশি ভুয়া নাম এন্ট্রি হয়। ফলে মোয়াল্লেম ফি এবং যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে বিপুল সংখ্যক বৈধ হজযাত্রীর। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি সুষ্ঠু সমাধানের নিশ্চয়তা দিয়ে আসলেও তা দৃশ্যমান হয়নি। অবশেষে হজ ফ্লাইট শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্দোলনে নামে বঞ্চিত এজেন্সির মালিক ও অপেক্ষমাণ হজযাত্রীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল থেকে তারা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অপেক্ষমাণ হজযাত্রী এবং বঞ্চিত এজেন্সির প্রায় ৩ শতাধিক ব্যক্তি আশকোনা হজ ক্যাম্পের সামনের রাস্তার ফুটপাতে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা ধর্মমন্ত্রীর কাছে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে সৌদি হজ মন্ত্রণালয় ও অ্যাম্বাসাডরের সহযোগিতায় বয়োবৃদ্ধ হজ গমনেচ্ছুদের হজ পালনের স্বার্থে কমপক্ষে অতিরিক্ত ৫ হাজার হজযাত্রী প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ, এ বছর কোটা বঞ্চিত যেসব হজযাত্রী যেসব এজেন্সির মাধ্যমে টাকা জমা দিয়েছে তারা স্ব স্ব এজেন্সির মাধ্যমে ২০১৬ সালে হজে গমনের জন্য রেজিস্ট্রেশনকারী হিসেবে গণ্য করে মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি আদেশ জারি, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ও সংবাদ সম্মেলন করে তা অবহিতকরণ এবং হজযাত্রীদের সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ২০১৫ সালের হজ কার্যক্রমে নিয়োজিত সকল এজেন্সিকে একটি করে বারকোড প্রদান। এ ছাড়া ডিও লেটার দিয়ে যারা অবৈধ হজযাত্রীদের সৌদি আরব যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানানো হয়। অবস্থানকারীরা ফুটপাতেই নামাজ আদায় করেন। বৃদ্ধরাও এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। অংশগ্রহণকারীরা হজে যাওয়ার জন্য বিশেষ মোনাজাত করেন। এ সময় তারা কান্নাকাটি করেন। এদিকে কর্মসূচিস্থলে মাইক ব্যবহার করায় পুলিশ এসে নিষেধ করলে তারা মাইক খুলে ফেলেন। অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেয়া পাবনার বেড়া উপজেলার ৬০ বছরের আবদুল মালেক মির্জা বলেন, তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে ৯ বছর আগে। তখন থেকেই তিনি নিয়ত করেন হজে যাবেন। তার ছেলে জনতা ব্যাংকে চাকরি করেন। কিন্তু ছেলের ওই টাকা দিয়ে তিনি হজে যেতে চাননি। এ ছাড়া তার নিজের ব্যবসায় জমানো টাকাও রয়েছে। কিন্তু তিনি ওই টাকা দিয়েও হজে যেতে চান না। এজন্য তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করেছেন। ওই টাকা দিয়েই তিনি হজে যাওয়ার নিয়ত করেছেন। তারমতে পবিত্র হজে যাবো তাই নির্ভেজাল টাকা খরচ করছি। কিন্তু আজ ১৫দিন ধরে তিনি অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। মানসিকভাবে ভেঙ্গেও পড়েছেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার বাদশা গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ সোহরাব। তিনি বলেন, গত বছরও হজে যাওয়ার নিয়ত করেছিলেন কিন্তু যেতে পারেননি। তাই এ বছর আগে থেকেই টাকা পয়সা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু যেতে পারছেন না শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে আল্লাহর ঘরে যেতে চান। তার ধারণা, সরকার ইচ্ছা করলেই তিনি হজে যেতে পারবেন। এদিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করেও অবস্থানস্থলে বসে ছিলেন বঞ্চিত হজযাত্রীরা। রাতেও তারা অবস্থান করার কথা জানিয়েছেন। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা বলেন, এর আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু কোন ফল হয়নি। এদিকে কোটা বঞ্চিত এজেন্সির মালিকরা জানান, হজযাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও হজে পাঠাতে না পারায় তারা চাপে রয়েছেন। অনেকে হুমকিরও শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। এজন্য তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। কেএম ট্রাভেলস-এর মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, তার অধীনে ৭০ জন হজযাত্রী রয়েছেন। কিন্তু একজনও পাঠাতে পারেননি। তিনি বলেন, আমরা সৌদি দূতাবাসে কথা বলেছি। দূতাবাস তাদের জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী চাইলে একদিনে এ সমস্যা সমাধান করে দেয়া যায়। তিনি বলেন, ভারত সরকারের অনুরোধে তারা দেশেটি থেকে ৭ হাজার হাজী বাড়িয়েছে। পাকিস্তানের জন্য কোটা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এবার ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে তুলনামূলক কম হজযাত্রী যাচ্ছে। ওই কোটাগুলো খালি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ করলে বাংলাদেশ থেকেও হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো যাবে। তাই তিনি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এদিকে উদ্বুদ্ধ এ পরিস্থিতিতে হজ অফিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেককে গতকাল বিকালে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। তবে অবস্থানকারীরা জানান, তাদের দাবির মধ্যে দুর্নীতিবাজদের অপসারণের কথা থাকলেও প্রধান দাবি বঞ্চিতদের হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে বঞ্চিতদের একটি গ্রুপ দিনভর সভা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মিটিংয়ের কোন সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।