নির্বাচন অবাধ করতে হলে অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীন করতে হবে
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৩৪:০১,অপরাহ্ন ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ১১১১০ বার পঠিত
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির সাথে বিশিষ্টজনদের মতামতের প্রতিফলন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ-নিরপেক্ষ করতে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জোরালো হচ্ছে। বিশেষ ক্যাডারের, দলীয় এক সাবেক কর্মকর্তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দলীয় অনুগত বেশিরভাগ কমিশনার নিয়োগে নির্বাচন বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনরা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ করতে হলে অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীন করতে হবে। তারা বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দলীয় সরকারের অধীন সব নির্বাচনে দলীয় সরকারই বিজয়ী হয়েছে। আবার দলীয় সরকারের অধীনে গঠিত নির্বাচন কমিশনও দলীয়করণের ভূমিকা আছে। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ-নিরপেক্ষ করতে হলে অবশ্যই শুধু কমিশন নয় সরকারের ভূমিকাই মুখ্য থাকবে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, সর্বশেষ তিন বছর দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের এক ধরনের অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কাজী রকিব কমিশনের বিরুদ্ধে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নষ্ট, নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি সাংবিধানিক মতা প্রয়োগ না করার অভিযোগ রয়েছে। রকিব কমিশনের অধীনে হওয়া বিভিন্ন নির্বাচনে গোলযোগ-সহিংসতার পাশাপাশি ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শুধু ইউপি নির্বাচনেই শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি হয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নানা প্রক্রিয়ায় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও কমিশনকে দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে। নতুন ইসি গঠনে বিশিষ্টজনদের মতামতের পুরো প্রতিফলন দেখা না গেলেও নতুন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপে নির্বাচনের লক্ষ্যে কাজ করবেন এমন আশাবাদ করলেও তারা মনে করেন নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সরকারের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে থাকবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জে. (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সার্চ কমিটিতে আমরা আমাদের মতামত দিয়েছিলাম। ইসিতে কি ধরনের ব্যক্তি চাই, সেটি বলেছিলাম। তিনি বলেন, সার্বিক বিচারে আমরা আশাবাদী। দেখা যাক, নতুন ইসি তাদের কাজকর্মে কীভাবে এর প্রতিফলন ঘটাতে পারে। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে অবিশ্বাস জন্মেছে সেখানে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাটাই হবে নতুন ইসির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে কতদূর যেতে হবে, আইনের সংস্কার করতে সকলের সহযোগিতা কীভাবে পাওয়া যায় সেগুলোই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে শুধু নির্বাচন কমিশন নয় সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। সরকারের আন্তরিকতা ছাড়া সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ না হলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমদ বলেন, অতীতের সকল নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে করা সব নির্বাচনেই সরকারদলীয়রাই বিজয়ী হয়েছে। আবার দলীয় সরকারের অধীনে গঠন করা নির্বাচন কমিশন গঠনেও দলীয়করণ করা হয়েছে। তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির তালিকা নিয়েও প্রশ্ন করে বলেন, বিভিন্ন দলের তালিকায় অনেক গ্রহণযোগ্য ও বিশিষ্টজনের নাম থাকলে তারা এদের নামে সুপারিশ করেনি। আবার সুপারিশ করাদের থেকে দলীয় অনুগত আমলাদের প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করায় অনেক দলই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমাদের সংবিধানের বর্তমান অবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনই আগামী নির্বাচন হবে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচনেই সরকারদলীয়রাই নির্বাচিত হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান সংবিধানের অবস্থায় সব নির্বাচন নিয়েই অভিযোগের পাহাড় উঠেছে। তাই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে হলে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষতার পাশাপাশি সরকারেরও নিরপেক্ষ হতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, নতুন নিয়োগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে নিজেকে ছাত্রলীগের হল কমিটির নাট্য নেতার পরিচয় দিয়ে দলীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছেন। তাছাড়া গত নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচনি সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করেছেন। নির্বাচন কমিশন নিয়োগে দলীয় ব্যক্তিদের বাছাইয়ে সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করে সার্চ কমিটি করে সুপ্রিম কোর্টকেও বিতর্কে ফেলা হয়েছে। সার্চ কমিটির সুপারিশ গোপন করে লুকোচুরি করা হয়েছে। এমনভাবে দলীয় অনুগতদের নির্বাচন কমিশন গঠন করায় এদের অধীনে দেশবাসী নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করতে পারে না। এই কমিশন নিয়োগেই নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু নির্বাচন কমিশন নয় অবাধ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারেরও মূল ভূমিকা রয়েছে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি নিরপেক্ষ সরকারেরও প্রয়োজন।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি বস্তুনিষ্ঠ মানদন্ডের ভিত্তিতে নতুন ইসি গঠনের জন্য আমরা মতামত দিয়েছিলাম। একই সঙ্গে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের মতামতের প্রতিফলন আমরা পুরোটা দেখতে পাইনি। তিনি বলেন, নতুন ইসির জন্য যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা নতুন কিনা-সে বিষয়ে কোনো বিতর্কে যাব না। কিন্তু ২০ জনের তালিকা এবং যে প্রক্রিয়া, মানদন্ড ও পদ্ধতিতে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা অন্তত প্রকাশ করা উচিত ছিল। এত তড়িঘড়ির কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ বিষয়ে অন্তত জনগণকে আস্থায় নেয়ার দরকার ছিল। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়ে গেল। আমরা যারা মতামত দিয়েছিলাম তার কতটুকু বাস্তবায়ন হলো তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেল। তাহলে আমাদের মতামত কি লোক দেখানো কিনা এটাও একটি প্রশ্ন? যাদের দিয়ে নতুন ইসি গঠন করা হয়েছে তাদের বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না, তবে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়ে গেল। এত তড়িঘড়ি সময়ের মধ্যে ইসি গেজেট প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে? গতবারেও একদিন সময় নেয়া হয়েছিল। আমি মনে করি, ইসি গঠনে বিশিষ্ট নাগরিকদের মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বিশিষ্টজনদের মতামত ও পরামর্শগুলো যথার্থ বিবেচনা করা হয়নি। আর কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। করলে আগে থেকেই সাধারণ জনগণ জানতে পারত, এতে করে তাদের কাছে ইসি অধিক গ্রহণযোগ্য হতো। আমরা চেয়েছিলাম নির্বাচন ব্যবস্থায় যাতে জনগণের হারানো আস্থা ফেরানো যায়, কিন্তু আমরা সেটাও পাইনি। শুধু নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়েও ভূমিকা আছে। তিনি বলেন, সবশেষে এটাই বলতে পারি, সবকিছু সময়ের ওপর নির্ভর করছে। এক কথায় সময়ই সবকিছু বলে দেবে।