আমি ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি, খালেদা জিয়াকে বিচারক
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:১৫:১৫,অপরাহ্ন ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ | সংবাদটি ৪৭৪৮ বার পঠিত
ডেস্ক নিউজ: সময় দিব। আমার সময়ও শেষ হয়ে আসছে। আমি ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি। ছেড়ে যেতে পারলে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করব।’
বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ কথা বলেন। রাজধানীর বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানি চলছিল। আর আদালতে উপস্থিত ছিলেন মামলার প্রধান আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া ও তাঁর আইনজীবী আবদুর রেজাক খান আদালতের কাছে একাধিকবার সময় চান। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ কথা বলেন।
বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বকশীবাজারের বিশেষ জজ আদালতে পৌঁছান খালেদা জিয়া। সোয়া ১১টায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানি শুরু হয়।
শুনানির শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘এ মামলার কয়েকজন আসামির ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। আজ অপর আসামি খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে বক্তব্য গ্রহণ করা হোক।’
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান আদালতকে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর তদন্ত প্রতিবেদনে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অর্থ কোথা থেকে এসেছে এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি। কেননা তিনি প্রতিবেদনে বলেছেন, সৌদি আরবের ইউনাইটেড ব্যাংকের ডিডির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে টাকা এসেছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নথি দিতে পারেননি। বরং আমরা দাবি করছি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের জন্য কুয়েতের আমির মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্মরণে এ অর্থ প্রদান করেছিলেন।’
আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘এ বিষয়ে কুয়েত দূতাবাস আমাদের একটি প্রত্যয়নপত্রও দিয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অর্থ কোথা থেকে এসেছে তার উৎস বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা কুয়েত দূতাবাসের দেওয়া নথি আদালতে উপস্থাপন করেছি, যা মামলার নথি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই এ মামলার পুনর্তদন্ত দাবি করছি। এ ছাড়া এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা বেগম খালেদা জিয়াকে আসামিও করেনি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা এসে খালেদা জিয়াকে আসামি বানালেন। এ মামলার অনেক শূন্যতা রয়েছে। আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরাও করেছি। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কার নির্দেশে বেগম খালেদা জিয়ার নাম আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন? জবাবে দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা হারুন-আর রশিদ বলেছেন, বলব না। তাই আদালতের কাছে এ মামলা পুনর্তদন্ত করার জন্য আমরা আবেদন করছি। শুনানি মুলতবি করা হোক।’
এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে মামলা পুনর্তদন্তের আবেদন করার আইনি কোনো ভিত্তি নাই, ক্ষমতাও নেই। কেননা এতে করে আমাদের আবার তদন্ত করতে হলে কুয়েত যেতে হবে, কুয়েত দূতাবাসের কাছে যেতে হবে। মামলার এ পর্যায়ে এসে মামলার পুনর্তদন্ত করার আইনি কোনো ব্যাখ্যা বেগম জিয়ার আইনজীবীরা দেখাতে পারেনি। ওনারা দেশবরেণ্য আইনজীবী। এ ধরনের ব্যাখ্যা দিলে আমরা তাদের কাছে কী শিখব? এটা হতে পারে না। বিজ্ঞ আদালত আপনি আত্মপক্ষের বিষয়ে শুনানি শুরু করেন।’
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, আদালতের হাত অনেক লম্বা। আদালতের সহজাত ক্ষমতা রয়েছে। আদালত চাইলে একটি মামলার ন্যায়বিচারের স্বার্থে যেকোন আদেশ দিতে পারে। অতীতের অনেক বড় বড় মামলার ইতিহাস যদি আমরা দেখি সব মামলায় আদালতের নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। প্রসিকিউশন টিম একটি ফৌজদারি কার্যবিধির একটি ধারা পেশ করে আদালতের ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে না।
প্রসিকিউশন (দুদকের আইনজীবী) কি বলতে পারবে অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা টাকা কুয়েতের আমিরের দেওয়া টাকা নয়? তারা কি এ বিষয়টি প্রমাণ করতে পারবে? আমি বলব ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ ধারাবলে আদালতের ক্ষমতা অসীম।
এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘মামলাকে বিলম্ব না করে আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে বক্তব্য শুরু করা হোক।’ সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার উদাহরণ তুরে ধরে বলেন, ‘ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন একটি স্বর্ণখচিত অস্ত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দিয়েছেন। এ অস্ত্রের বিষয়ে মামলা হওয়ার পর ইরাক দূতাবাসের কর্মকর্তা এসে আদালতে তাঁর পক্ষে সাক্ষী দিয়ে গেছেন। সেটি আমরা মানছি। কিন্তু খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যের পর মামলা পুনর্তদন্তের আদেশ দেওয়া যাবে। আজ পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী আদালত তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আমি অনুরোধ করছি।’
এ পর্যায়ে আদালত আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে শুনানি করতে গিয়ে খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘আপনার বর্তমান বয়স কত? বাহাত্তর নাকি তেয়াত্তর?’
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়া কোনো উত্তর দেননি। তবে তাঁর আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘দুদকের আইনজীবী আমাদের অনেক কিছু ব্যঙ্গ করেছেন আমরা কিছু মনে করিনি। আমাদের বক্তব্য হলো মামলা পুনর্তদন্তের বিষয়ে আমাদের আবেদন আগে নিষ্পত্তি করে তারপর আত্মপক্ষ সমর্থনে বিষয়ে শুনানি হোক। এ আদালতে আবেদন খারিজ হলে আমরা উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে যাবে। তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য যদি এ মুহূর্তে গ্রহণ করা হয় তাহলে তো এ মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুযায়ী বিচার শুরু হবে। আর যদি আমাদের আবেদন গ্রহণ করা হয় তাহলে তো মামলার কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে। বর্তমানের সব তথ্য-উপাত্ত পরিবর্তন হবে।’
এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘মামলাকে বিলম্বিত করতে তারা নানাভাবে দরখাস্ত, আবেদন করে যাচ্ছে। আর আপনিও সময় দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে এক মামলা নিয়ে বছরের পর পর চলতে পারে না। হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা রয়েছে দুদকের মামলা ৬০ কার্য দিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হয়।’
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘আমাদের পুনর্তদন্তের আবেদন নিষ্পত্তির আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য হতে পারে না। আমি বেগম খালেদা জিয়াকে বলেছি, আপনি বক্তব্য দেবেন কি না? তিনি অনেক প্রাজ্ঞ। তিনি বলেছেন, আমি সময় হলে বলব। কারণ আমি বলে ফেললে সব কিছুই তো শেষ।’
এ পর্যায়ে আদালত আবার খালেদা জিয়ার বয়স জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন। আদালত বলেন, ‘আসামি বেগম খালেদা জিয়া। স্বামী মরহুম জিয়াউর রহমান। ৮৯ নং সড়ক, গুলশান-২। ফিরোজা বেগম ভবন। আপনি বলেন, আপনার বর্তমান বয়স কত?’
এ সময় খালেদা জিয়া দাঁড়িয়ে আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি আপনার কাছে সময় চাই।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘আদালত আপনাকে সম্মান দিয়েছে। আপনার প্রতি আদালতের সম্মান থাকবে। কিন্তু আপনি আজ সময় চাইলে আগামীকাল বা পরশু আবার আসতে হবে। আজ আপনি বলতে হবে না। আমি আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষীদের বয়ান পড়ি। আপনি বসে বসে শুনুন। এতে আপনার কোনো কষ্ট হবে না।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে এজলাসের কাছাকাছি গেলে আদালত বলে ওঠেন, ‘এটি খুব বিরক্তিকর দেখাচ্ছে। আপনারা আসনে বসেন।’
বিচারক আবু আহমেদ জমাদার বলেন, ‘আমি ২০১৬ সালে ১৪৪টি মামলার রায় প্রদান করেছি। তম্মধ্যে অনেক বড় বড় মামলা রয়েছে। কিন্তু এ মামলার অভিযোগ গঠন হয় ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি এ মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করি ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর। তাই মামলা যদি শুনতে না পারি তাহলে তো আমার এখানে আসার দরকার নাই।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘আপনি আমাদের দুই দিন সময় দেন। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে দিন ধার্য রয়েছে। ওই দিন পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হোক।’
বিচারক আবু আহমেদ জমাদার বলেন, ‘সময় দিব। আমার সময়ও শেষ হয়ে আসছে। আমি ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি। ছেড়ে যেতে পারলে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করব।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘দুপুর দেড়টা বেজে গেছে। বিরতি দেওয়া প্রয়োজন। আপনারা চা নাস্তা খেয়ে আসেন। আমার উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সমস্যা রয়েছে। এ মুহূর্তে আমি যদি মারা যাই, সবাইকে সাক্ষী রেখে বলছি বেগম খালেদা জিয়া হবেন প্রধান আসামি।’
এরপর আদালত দুপুর দেড়টার কিছুর পর দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি ঘোষণা করেন।
এ সময় খালেদা জিয়া আদালতের এজলাসের সামনে একটি চেয়ারে বসে থাকেন। উভয় পক্ষের আইনজীবীরা অপেক্ষায় থাকেন। এরপর আদালত বিরতি শেষে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে শুনানি কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী জয়নুল আবেদিন আবার আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে সময় আবেদন করে বলেন, বিজ্ঞ আদালত দুদিন সময় দেন। এ মুহূর্তে বিরতি দেওয়ায় খালেদা জিয়া খাওয়া, নামাজ কিছুই আদায় করতে পারেননি।
আদালত ওই আবেদন নাকচ করেন। পরে অপর আইনজীবী জাকির হোসেন আদালতকে বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় আপনার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছি।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘আমি আপনাদের অধিকার তো হরণ করতে পারি না। লিখিতভাবে দিতে পারেন।’
এ পর্যায়ে সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রেজাক খান আবার অনুরোধ করলে আদালত মামলার পুনর্তদন্তের বিষয়ে আবেদন নিষ্পত্তি করে আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে মুলতবি করতে বলেন।
পৌনে ৪টার দিকে আদালত শুনানি আগামী ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করে ওই দিন সব আসামিকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকার বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আজ খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত হন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় আরো একটি মামলা করে দুদক।
মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।]