*সোয়ালেহীন করিম চৌধুরী*
যদিও প্রোপর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) পদ্ধতিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি ন্যায়সঙ্গত ও সুশৃঙ্খল উপায় হিসেবে প্রচারিত, তবে এর বাস্তব প্রয়োগে বিভিন্ন দেশে যেসব জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা আমাদের বিশ্লেষণ করা জরুরি। প্রপর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন একটি উদার ও ন্যায়বিচারমূলক পদ্ধতি মনে হলেও, তার বাস্তবায়নে প্রাপ্ত ফলাফল সবসময় সুষ্ঠু বা দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্রের ভিত্তি হতে পারে না। এই পদ্ধতির যে সকল সমস্যা রয়েছে তা তুলে ধরে আমরা দেখতে পারি কেন এটি সব দেশে সমানভাবে কার্যকর নয়, এবং বাংলাদেশে এর প্রয়োগ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে।
*জোট সরকার ও অস্থিতিশীলতাঃ*
PR পদ্ধতিতে, কোনো দল যদি নির্বাচনে বেশিরভাগ ভোট না পায়, তবে তাদের জন্য জোট গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এটি একদিকে বিভিন্ন মতামত এবং গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে, তবে অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, যেমন ইতালি বা স্পেনের মতো দেশগুলিতে, ছোট ছোট দলগুলোর প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের মধ্যে মতানৈক্য রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্থিরতা আনে না। এতে সরকার গঠন করতে সময় বেশি লাগে এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অসুবিধা দেখা দেয়।
*ছোট দলের অত্যধিক প্রভাবঃ*
PR পদ্ধতির একটি নেতিবাচক দিক হলো যে ছোট ছোট দলগুলি অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অতিরিক্ত প্রভাব ফেলতে পারে। কখনও কখনও, একটি ছোট দল নির্বাচনে ছোট পরিমাণ ভোট পেয়েও সরকারের নীতির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ভূমিকা রাখে। এতে অনেক সময় এই ছোট দলের আঞ্চলিক বা বিশেষ কোনো স্বার্থের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা সার্বিক জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে মেলে না। উদাহরণ হিসেবে, ইসরায়েল এবং ব্রাজিলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখলে দেখা যায় যে, সেখানে ছোট দলের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
*নির্বাচনী জটিলতা এবং ভোটারের বিভ্রান্তিঃ*
PR পদ্ধতিতে ভোটের বিভাজন এবং আসন বণ্টন নিয়ে জটিলতা থাকে। জনগণকে বুঝতে হয় কিভাবে তাদের ভোটের ফলাফল আসন বণ্টনে প্রভাবিত হবে, যার ফলে কিছু ভোটার বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। এটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। অনেক দেশে, যেমন হাঙ্গেরি এবং ফিলিপাইনে, PR পদ্ধতিতে ভোটদানকে অনেক মানুষই কঠিন এবং বিভ্রান্তিকর মনে করেন, যার ফলে নির্বাচন কম অংশগ্রহণকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
*একাধিক রাজনৈতিক দলের দুর্বলতাঃ*
PR পদ্ধতিতে অধিকাংশ সময় নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা এবং সমর্থন দরকার পড়ে, কিন্তু এটি একক দলের শক্তিশালী নেতৃত্বকে কমিয়ে দেয়। এটি অনেকসময় রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি করে, কারণ কোনো দলের পক্ষে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে যেখানে PR পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ এবং জোট গঠনে টানাপোড়েন খুব সাধারণ ঘটনা। এতে সরকারের কর্মকাণ্ডে স্থিতিশীলতা কমে যায় এবং জনগণের আস্থা হারানো যায়।
*বিরোধী দলের অতিরিক্ত শক্তিঃ*
PR পদ্ধতিতে বিরোধী দলগুলোর কণ্ঠস্বর খুব শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, যা দেশের শাসনব্যবস্থায় অবশিষ্ট একতা বা সমঝোতা বিঘ্নিত করতে পারে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে, বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ বা মুঠোভারী রাজনৈতিক দলগুলি সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার বিরোধিতা করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলে। কিছু দেশে যেমন আয়ারল্যান্ডে এবং পোল্যান্ডে, বিরোধী দলের অতিরিক্ত শক্তি কার্যকরী সরকারের জন্য অনেক সময় বাধা সৃষ্টি করে।
*অতিরিক্ত জটিল ভোট গণনা প্রক্রিয়াঃ*
PR পদ্ধতির ভোট গণনা প্রক্রিয়া সাধারণত বেশ জটিল, এবং এটি নির্বাচনের পরে ফলাফল দ্রুত ঘোষণা করা কঠিন করে তোলে। ফলস্বরূপ, ভোট গণনার পদ্ধতিতে ভুল বা সময়ক্ষেপণ হতে পারে, যা জনগণের মধ্যে নির্বাচনী সিস্টেম নিয়ে সন্দেহ এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডসে PR পদ্ধতিতে ভোট গণনার ফলাফল কখনও কখনও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থগিত থাকে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
*স্বতন্ত্র প্রার্থীর অংশগ্রহণে জটিলতাঃ*
Proportional Representation (PR) পদ্ধতিতে যেখানে আসন বণ্টন হয় ভোটের শতাংশ অনুযায়ী, সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণ অনেকসময় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু জটিলতা তৈরি করতে পারে। PR পদ্ধতিতে সাধারণত দলীয় ভিত্তিতে ভোট গ্রহণ করা হয়, যার ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সংসদে জায়গা পাওয়া বা তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা কঠিন হতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থী অনেক সময় খুব কম ভোট পেলেও, তারা দলের সঙ্গে যোগদান না করায় আসন জেতার সুযোগ হারাতে পারেন। PR পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হয় নির্দিষ্ট একটি হিসাবের মাধ্যমে, যেখানে জটিল গণনা পদ্ধতির প্রয়োজন। যদি কোনো নির্বাচনে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন, তবে তাদের জন্য প্রতিযোগিতার পরিমাণ এবং আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা সৃষ্টি হতে পারে। গণনা পদ্ধতি এবং অ্যালগরিদমের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে, নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা হতে দেরি হতে পারে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অবস্থান পরিষ্কার করা কঠিন হতে পারে।
*উপসংহারঃ*
যদিও Proportional Representation (PR) পদ্ধতি কিছু দেশে নির্বাচনী ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের উন্নতি ঘটাতে পারে, তবে এটি সব দেশের জন্য একদম উপযুক্ত নাও হতে পারে। বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগে দেখা যায় যে, এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কার্যকরী সরকার এবং সাধারণ জনগণের আস্থার প্রশ্নে কিছু জটিলতা এবং সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশ শক্তিশালী এবং একক আধিপত্যের প্রবণতা রয়েছে, PR পদ্ধতির বাস্তবায়ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনগণের বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে। তাই, PR পদ্ধতির প্রবর্তনকে আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা ও সাবধানতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
*(লেখকঃ নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ডেমক্রেসি এন্ড গুড গভর্নেন্স)*