স্বপ্ন পূরণ হলো না আলীর
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৪৫:৩৩,অপরাহ্ন ১৩ আগস্ট ২০১৫ | সংবাদটি ৩২৯ বার পঠিত
স্টাফ রিপোর্টার,
আলীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন মা কুলসুমা। ছেলে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। সংসারের অভাব ঘুচবে। কিন্তু না কুলসুমার এ স্বপ্ন পূরণ হলো না। পুত্র আলীকে নিজ গ্রুপের সদস্যরাই হত্যা করেছে। এর সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে কুলসুমার স্বপ্নকেও। পুত্র হত্যার খবর শুনে মা কুলসুমা ছুটে যান। পুত্রের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তার স্বপ্নের কথা বলছিলেন। এ সময় সিলেট মদন মোহন কলেজ ক্যাম্পাসে নেমে আসে রাজ্যের নীরবতা। সবার চোখে পানি। গতকাল ছাত্রলীগের একই গ্রুপের কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয় কলেজ ছাত্রলীগ কর্মী আলী হায়দার তালুকদার ওরফে আবদুল আলী। দুপুরে কলেজ ক্যাম্পাসে শ’শ শিক্ষার্থীর সামনে নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। আর এ ঘটনার পর একই গ্রুপের ছাত্রলীগের সিনিয়র কর্মীরা প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে চলে যায়। এদিকে, এ ঘটনার পরপরই পুলিশ অভিযান চালিয়ে নগরীর চন্ডিপুল এলাকা থেকে ছাত্রলীগ ক্যাডার প্রণজিত দাশকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্রণজিত খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। বলেছে, তার ছুরির আঘাতেই খুন হয়েছে আবদুল আলী। আলী হায়দার তালুকদার ওরফে আবদুল আলী মদন মোহন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ছাত্রলীগের বিধান গ্রুপের উপ গ্রুপ রিকাবীবাজার গ্রুপের কর্মী। তার বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম ইউনিয়নের নিজ সিলাম গ্রামে। পিতা আকলিস আলী ও মা কুলসুমা খাতুন। বাড়ি থেকে এসে পড়ালেখা করতো। তবে, ছাত্রলীগের বিধান গ্রুপের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তার পরিচিতি ছিল কলেজে। ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, একই কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী প্রণজিতসহ কয়েক জনের সঙ্গে মঙ্গলবার সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। গতকাল সকাল থেকে নিজ দলের কর্মীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিল আবদুল আলী। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় সেখানে হাজির হয় প্রণজিতসহ অন্যরা। তারা আবদুল আলীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে প্রণজিত তাকে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত আবদুল আলীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে উপস্থিত ছাত্রলীগ কর্মী আলীর সহপাঠীরা জানায়, প্রণজিতসহ কয়েকজন হঠাৎ এসে হামলা করে। কোন কিছু বুঝার আগেই প্রণজিত তাদের সহপাঠী আলীর বুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। এ সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আবদুল আলী। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন আবদুল আলীর পিতা আকলিস আলী ও মা কুলসুমা বেগম। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, ছুরিকাঘাতের ফলে আবদুল আলীর হার্ট ছিদ্র হয়ে গেছে। ফলে তার শরীর দিয়ে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়। তাকে বাঁচাতে ১০ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল পৌনে ৩টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। তার মৃত্যুর পর হাসপাতালে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আবদুল আলীর পিতা আকলিস মিয়া ও মা কুলসুমা বেগম। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে হাসপাতালের পরিবেশ। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার সহপাঠীরাও। মৃত্যুর সংবাদ শুনে হাসপাতাল এলাকায় ছুটে যান তার সহপাঠী ছাত্রলীগ কর্মীরা। এ সময় তারা আবদুল আলীর লাশ দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তারা ওসমানী হাসপাতাল এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা খুনের ঘটনার জন্য ছাত্র শিবিরকে দায়ী করে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে মিছিলে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। ওদিকে, ছেলে আবদুল আলীর লাশ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন পিতা আকলিস আলী। তিনি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন জরুরি বিভাগের সামনে। বলেন, ‘আমি ছেলেকে পড়ালেখার জন্য নামি কলেজে ভর্তি করি। অনেক কষ্ট করে ওর পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করছিলাম। ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে হবে এমনটি ভাবিনি।’ বাকরুদ্ধ পিতা আকলিস আলী এ সময় তার ছেলের খুনিদের ফাঁসি দাবি করেন। এদিকে, আবদুল আলী খুনের ঘটনার পর সিলেটের মদন মোহন কলেজ ক্যাম্পাসে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কলেজের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, গতকাল ক্যাম্পাসে বড় কোন ঘটনা ঘটেনি। তবে, ছুরিকাঘাতের খবর তারা শুনেছেন। আর শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, গেলো কয়েক দিন ধরে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছিল। ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভক্ত হয়ে মহড়াও দেয়। এতে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল তটস্থ। আর গতকাল খুনের পর ক্যাম্পাস হয়ে গেছে সুনসান নীরব। এদিকে, ছুরিকাঘাতের পর যখন আবদুল আলীকে হাসপাতালে নেয়া হয় তখন কোতোয়ালি থানা পুলিশ তার সঙ্গে কথা বলে। মৃত্যুর আগে আবদুল আলী জানিয়েছিল প্রণজিতসহ কয়েকজন এসে তাকে ছুরিকাঘাত করে। কলেজ ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করেছিল আলী। পুলিশ হাসপাতালে আবদুল আলীর মুখ থেকে আসামিদের নাম পাওয়ার পর অভিযান শুরু করে। পুলিশের কয়েকটি দল আসামি ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কোতোয়ালি পুলিশ নগরীর চন্ডিপুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে প্রধান অভিযুক্ত প্রণজিত দাশকে। গ্রেপ্তারের পর তাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। পুলিশ জানায়, খুনের ঘটনার পর প্রণজিত সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এ কারণে সে চন্ডিপুল এলাকায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার ও সাব ইন্সপেক্টর ফয়েজ আহমদ জানিয়েছেন, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্রণজিত দাশ খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। সে জানিয়েছে, নিজেই আবদুল আলীকে সে ছুরিকাঘাত করেছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে। এদিকে, বিকালে পুলিশ অভিযান চালিয়ে রাহুল নামে আরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাকে কোতোয়ালি থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল বলে জানায় পুলিশ। কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার আরও জানান, খুনের ঘটনায় মামলা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দেয়ার পর আসামি প্রণজিতকে আদালতে প্রেরণ করা হবে। প্রণজিতের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায়। সে মেজরটিলা এলাকায় বসবাস করতো। আর সিলেটের মদন মোহন কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। সে ছাত্রলীগের বিধান গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিল। এ ছাড়া নগরীর রিকাবীবাজার এলাকায় সে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ পরিচালনা করতো বলে জানা গেছে।