‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০৮:৫৩,অপরাহ্ন ২৭ আগস্ট ২০১৫ | সংবাদটি ৪৬৯ বার পঠিত
তার এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য।’ বিশ্ব মানবতার জয়গানে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূ-লোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’- ওঠার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে খুলে দিয়েছেন বিস্ময়কর নতুন দিগন্ত। প্রেম দ্রোহ সাম্য মানবতার মহাকবি তিনি। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিস্ময়কর এই তূর্যবাদকের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৬ সালের এই দিনে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তত্কালীন পিজি হসপিটালের ১১৭ নম্বর কেবিনে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। সে দিন ছিল বাংলা ১২ ভাদ্র। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও নজরুল কখনো আপস করেননি। ‘চির বিদ্রোহী বীর’, ‘চির উন্নত শির’-এর কবি মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবতা আর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্য গগনে। মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন অভাবনীয় কণ্ঠ। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্…’। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসঙ্গীত।
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে দুরন্ত এক শিশুর জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে)। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গোটা উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি ও চেতনার মহাকবি। বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলে, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি করে অজেয় শক্তির লেখনী দিয়ে প্রতিবাদ গড়ে জেল খেটেছেন। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সব অবিচার-অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছেন দুহাতে। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও। ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক, নতুন ধারা, নতুন মাত্রার বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। শুধু কবিতাতেই নয়, বাংলায় সঙ্গীত সৃষ্টিতে নজরুল অভূতপূর্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার সঙ্গীত রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে। রাগনির্ভর গানকে ভেঙেচুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সঙ্গীতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও কবি হিসেবেই তিনি বিশ্ব পরিচিতি, বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার অনন্য সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি।
নজরুল তদানীন্তন পূর্ববাংলায় তথা আজকের বাংলাদেশে এসেছেন অনেকবার। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুরে কৈশরের অনেকটা সময় কেটেছে তার। জীবনের মধ্যপথে তেজোদ্দীপ্ত কবি অকস্মাত্ নির্বাক হয়ে যান। চিরতরে মূক হয়ে পড়েন গানের পাখি। সময়টা ১৯৪২ সালের শেষার্ধ।
১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তত্কালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় মহাকবিকে।
আজ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মানুষ স্মরণ করবে জাতীয় কবিকে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পালিত হবে নানা কর্মসূচি। আজ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে কবির সমাধি ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাণীতে বলা হয়, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতির সামনে চলার পথে অন্তহীন প্রেরণার উত্স। আমরা সবাই জানি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার কবিতা ও গান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আজও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে তার কবিতা ও গান আমাদের শক্তি, সাহস জোগায়। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম মানবতা ও সাম্যের চেতনায় তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। নজরুল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমকে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন উল্লেখ করে বাণীতে বলা হয়, তার রচিত কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম তাকে বিদ্রোহী কবির খ্যাতিও দিয়েছে।
কর্মসূচি: জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করছে। প্রতি বছরের মতো এবারও সকাল ৭টায় কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে থাকবে আলোচনা, পাঠ, আবৃত্তি, গান ও গানসহযোগে নৃত্য। ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম শহরে সমান গুরুত্ব দিয়ে নজরুল মৃত্যুবার্ষিকী পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যৌথভাবে নজরুল মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে। সকাল ৭টায় শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেলে জাতীয় নাট্যশালায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে।
নজরুল একাডেমি ২৭ ও ২৮ আগস্ট দুইদিনব্যাপী আনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় শ্রদ্ধা নিবেদন ও সুরা ফাতেহা পাঠ শেষে বেলা ১১টায় মগবাজারের নজরুল একাডেমি বিদ্যালয়ে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ২৮ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় নজরুল একাডেমি মিলনায়তনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে। এছাড়াও একাডেমির বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আলোচনা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেবেন।
বিএনপি মাজারে শ্রদ্ধা জানাবে
আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে বিএনপি।