যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়া ইসরাইলি সন্ত্রাসীরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:১০:৩৮,অপরাহ্ন ২২ অক্টোবর ২০১৫ | সংবাদটি ২৫৮ বার পঠিত
৩১শে জুলাই দখলকৃত পশ্চিম তীরের দুমা গ্রামে ১৮ মাস বয়সী আলি দাওয়াবশেশকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সমস্ত তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারী সন্ত্রাসবাদীদের ইচ্ছাকৃত কাজের ফল এটি। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ওই হামলার জন্য দায়ীদের অনেকের জন্মই ইসরায়েলে নয়। তাদের জন্ম আমেরিকায়। তাদের কম্যুনিটিতে এসব নিয়ে খুব কমই উচ্চবাচ্য হচ্ছে। বসতিস্থাপনকারী রাবাই ও পশ্চিম তীরে আমেরিকান অভিবাসী কম্যুনিটিগুলো ওই অপরাধকে খর্ব করে দেখছে। অথবা নীরব থাকছে।
২ দশক আগে এরকম আরেকটি ঘৃণ্য ঘটনায় তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইয়িতঝ্যাক রবিনের প্রতিক্রিয়া এ ক্ষেত্রে মনে করা যায়। আমেরিকায় জন্ম নেয়া ডাক্তার বারুচ গোল্ডস্টেইন ১৯৯৪ সালে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করে। ওই ফিলিস্তিনিরা তখন হেব্রনে নামাজ আদায় করছিলেন। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে দাঁড়িয়ে শীতল কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী রবিন বলেন, তার (বারুচ গোল্ডস্টেইন) জন্ম অন্য কোথাও। তার খুনে মানসিকতা এখানে দেখা গেছে, সাগরের অপর তীরে দেখা গেছে। এরা ইহুদি ধর্মমতের কেউ নয়! এরা আমরা নই। রবিন বলতে থাকেন, তুমি বিদেশী আগাছা। তুমি এক অসভ্য আগাছা। ইহুদি ধর্মমত তোমাকে থুতু মেরে বহিষ্কার করছে।
১৯৯৪ সালের সেই ভয়ানক ঘটনাটি ছিল ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের দেখা বসতিস্থাপনকারীদের সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে রক্তাক্ত ও ধ্বংসাত্মক নমুনা। সে ঘটনার ২ বছরেরও কম সময় পর প্রধানমন্ত্রী রবিন নিজেই নিহত হন। তাকে খুন করে উগ্র জাতীয়তাবাদী এক আততায়ী। তখন হঠাৎ করে ইসরাইলে আমেরিকান ইহুদি অভিবাসীদের একটি গোষ্ঠী যারা সমাজে কোন রকম ঝুলে ছিল, তারা একরকম জাতিচ্যুত গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট চাইম হেরজগ যুক্তরাষ্ট্রকে আখ্যায়িত করেছিলেন ইহুদি সন্ত্রাসবাদের ‘প্রজননস্থল’ হিসেবে। দৈনিক পত্রিকা মারিভ সেসব আমেরিকান ইহুদিদের তীব্র সমালোচনা করেছিল, যারা তাদের ‘উন্মাদ সন্তানদের ইসরাইলে পাঠায়’। এক ইসরাইলি সাংবাদিক ‘আগামী দিনের বারুচ গোল্ডস্টেইনদের বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণে’র দাবি জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এর ২ দশক পরও ৩১শে জুলাই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে আলি দাওয়াবশেশক ও তার পরিবারকে। বছরের পর বছর ধরে সহিংস অপরাধবৃত্তিতে জড়িত বসতিস্থাপনকারীদের বিচারহীনতার পর ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেট ওই ঘটনায় ধরপাকড় শুরু করে। এখন পর্যন্ত সেটেলার সন্ত্রাসবাদের সাম্প্রতিকতম নমুনাটির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৪ যুবককে আটক করেছে সংস্থাটি। এদের তিন জনেরই মূল প্রোথিত রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
সংস্থাটির ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ইহুদি চরমপন্থি হলো, ২৪ বছর বয়সী মেইর ইত্তিঙ্গার। তার বংশের অনেকেই সহিংস ও বর্ণবাদী সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার দাদা মেইর কাহানে ছিলেন একজন উগ্র আমেরিকান রাবাই। ১৯৭১ সালে তিনি ইসরাইলে অভিবাসী হন। সেখানে কাচ পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৮৮ সালে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার আগ পর্যন্ত তিনি নেসেটে দলটির একমাত্র সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে নিউ ইয়র্কে আততায়ীর হাতে নিহত হন কাহানে। কিন্তু তিনি ইসরাইলের বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও উগ্র-জাতীয়তাবাদী দলগুলোর বুনিয়াদ স্থাপন করার অন্যতম কারিগর। আটককৃত আরেক যুবকের নাম মোরদেচাই মেয়ের। ১৮ বছর বয়সী এ যুবক জেরুজালেমের বাইরে মালে আদুমিমের বসতিস্থাপনকারী। সে-ও এক আমেরিকান অভিবাসীর পুত্র। মোরদেচাই মেয়েরের পিতার দাবি, তার ইচ্ছা তোরাহ পাঠ করা ও পশ্চিম তীরে রোমাঞ্চকর কাজ করে বেড়ানো। আরেক আমেরিকান বসতিস্থাপনকারী খান্টসিস আদালতে শিন বেট এজেন্টকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে আটক হয়। আটককৃত চতুর্থ যুবক এভিয়েটার সেøানিম এক অস্ট্রেলিয়ান ইহুদি অভিবাসীর পুত্র।
ইসরাইলে আমেরিকান বসতিস্থাপনকারী উগ্রপন্থিদের দীর্ঘ তালিকায় নবতম সংযোজন ইত্তিঙ্গার, মেয়ের ও খান্টসিস। ব্রুকলিনে জন্ম নেয়া এক সেটেলার (বসতিস্থাপনকারী) এরা রাপাপোর্ট ১৯৮০ সালে নাবলুসের মেয়রের ওপর গাড়িবোমা হামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাল্টিমোর বংশোদ্ভূত অ্যালান গুডম্যান ১৯৮২ সালে মসজিদ-আল-আকসায় গুলি চালিয়ে ২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও ১১ জনকে আহত করেছিল। ব্রুকলিনে জন্ম নেয়া আরেক অভিবাসী ইওয়েল লার্নারকে একই বছর ইসরাইলি সরকারকে উৎখাত ও মসজিদ-আল-আকসা উড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের অভিযোগে কারাদ- দেয়া হয়। সেইন্ট লুইসে জন্ম নেয়া ইয়িতঝ্যাক গিন্সবার্গের মতো রাবাইরা এখন উগ্রপন্থি ধ্যানধারণা দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিচ্ছে তরুণ ইহুদিদের মগজে।
আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন সূত্র ও অন্যান্য গবেষণা অনুযায়ী, ইসরাইলের মোট বসতিস্থাপনকারীদের ১২-১৫ শতাংশ আমেরিকান বংশোদ্ভূত। এদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার। এদের কিছু বসবাস করেন তীব্র উগ্রপন্থী শিবিরগুলোতে। তবে বেশির ভাগই জেরুজালেমের পাশে বসবাস করেন। এরাই সবচেয়ে বেশি আদর্শ ধারণ করে। বাইবেলকে উদ্ধৃত করার বদলে নিজেদের কর্মকা-কে বর্ণনা করার বেলায় আমেরিকান মূল্যবোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে এদের মধ্যে। তাদের কাছে, তাদের কর্মকা- মানবাধিকার রক্ষা ও ‘সমগ্র ইসরাইলে বসবাস করা’র অধিকারের পক্ষে সুযোগ। তাদের কাছে পশ্চিম তীরে বসবাস করা আর নতুন ইসরাইলী সীমান্তের অগ্রপথিক হওয়া একই বিষয়। ফিলিস্তিনিদের ব্যাক্তিমালিকানাধীন জমিতেও হানা দেয়া তাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তাদের মধ্যে যারা একটু বেশিই উগ্র, তারা কেবল আদর্শ ধারণ করেই খ্রান্ত দেয় না। বাছবিচারহীন সহিংসতায় রুপান্তরিত হতে তাদের আদর্শ খুব বেশি সময় নেয় না।
অবশ্য এরপরও অনেক আমেরিকান বসতিস্থাপনকারী নিজেদের উদারপন্থী হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। এদের বিশাল অংশই যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন ডেমোক্রেটিক ভোটার ছিলেন। ইসরাইলের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের আগে এদের অনেকে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৯০-এর দিকের রাবাই শ্লোমো রিজকিন যেমন ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমি মার্টিন লুথার কিং-এর সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটেছি। আমি সম-অধিকারের বিষয়টি ভেতর থেকে অনুভব করি। তবে তার মতে, বসতিস্থাপনকারীরা এখন ভুক্তভোগী। তার যুক্তি, আমরা এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছি, যারা আমাদের নিয়মানুসারে খেলে না। আরবরা নিজেদের মানুষদের সঙ্গে যেমন বর্বর আচরণ করে, তা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের মূল লক্ষ্য থাকে আত্মহত্যার পর্যায়ে পড়ে এমন বোকামি না করা। তিনি এমনকি ইসরাইলে বসতিস্থাপনকারীদেরকে তুলনা করলেন আফ্রিকান-আমেরিকানদের অবস্থার সঙ্গেও! এমন আরেক সেটেলার অ্যাক্টিভিস্ট ইয়েচিল লেইটার আবার লিঙ্কনের বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে নিজেদের কর্মকা- জায়েজ করলেন: স্বাধীনতার জন্য কিছুটা মূল্য চুকাতে হয়।
এ দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করাই নয় শুধু। তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে অনবরত উদারমনা কথাবার্তা বলতে শিখেছে। জনসংযোগ খাতে ইসরাইলের বসতিস্থাপনের বিষয়টি ইতিবাচক ধাঁচে প্রচার করার বেলায় এসব আমেরিকান ইহুদির ভূমিকাই মুখ্য। এসব উদারমনা আমেরিকানরাই ইহুদিদের অপরাধকর্ম থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতে মূল ভূমিকা পালন করছে।
যেমন, মোরদেচাই মেয়েরকে যখন কোন বিচার ছাড়া আটক রাখা হয়, তখন তার পিতামাতা একটি সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে তাদের পুত্রকে আটক রাখার নিন্দা জানিয়ে তারা বলেন, আমরা আমেরিকান নাগরিক। আমাদের সন্তান সেখানে বড় হয়েছে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরেকটি গণতান্ত্রিক দেশে এসেছি। তাদের অভিযোগ, এখন তাদের সন্তান কারাগারে, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। তাদের বক্তব্য সঠিক। প্রশাসনিক এসব আটকাদেশ গণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ইসরাইলের বিচার প্রক্রিয়ার অনুদার প্রবণতার বিষয়টি সামনে এনে তারা তাদের সন্তানের কৃতকর্মের বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া একই আইনে যখন শতশত ফিলিস্তিনিকে আটক করে রাখা হয় যতদিন ইচ্ছা ততদিন, তখন এসব সেটেলারদের কিছুই বলতে শুনিনি আমরা। এই মেয়ের পরিবারের মতো ইসরাইলের এমন অনেক আমেরিকান ইহুদি বসতিস্থাপনকারী ভীষণ অনুদার বসতিস্থাপন প্রকল্প সমর্থনের পাশাপাশি উদারপন্থিদের মতো ভাষা ব্যবহার করার মধ্যে স্ববিরোধিতা খুঁজে পান না।
ইহুদি সন্ত্রাসবাদের সাম্প্রতিকতম এ ঘটনায় আমেরিকান বসতিস্থাপনকারী নেতারা একেবারেই নিশ্চুপ। যদি ইসরাইলে অভিবাসিত হওয়া আমেরিকানরা বিশ্বাস করেন যে, তাদের লালিত মূল্যবোধের সঙ্গে এসব সহিংস সন্ত্রাসবাদের কোন স¤পর্ক নেই, তবে কেন তাদের রাবাইরা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে জোর গলায় তাদের নিজ পরিবার ও সম্প্রদায়ের এসব সন্ত্রাসীদের নিন্দা জানাচ্ছেন না? কেন এখন তাদের মতামত কলাম দেখা যাচ্ছে না আমেরিকান ও ইসরাইলি পত্রিকাগুলোতে? দেশে বিদেশে আমেরিকান ইহুদিরা ইসরাইলের ইহুদি চরমপন্থার প্রসঙ্গ এলেই নীরব থাকাকে আর অগ্রাহ্য করে যেতে পারেন না। যারা বিচার ও শান্তিপ্রত্যাশী, তাদের সকলেরই কর্তব্য রবিনের আহ্বান অনুযায়ী আমাদের মাঝ থেকে সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যাক্তিদের জড় উৎপাটন করা।
[সারা ইয়াএল হার্সকর্ন বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ লেকচারার ও ফেলো। প্রকাশিতব্য ‘সিটি অন আ হিলটপ: আমেরিকান জিউস অ্যান্ড দ্য ইসরাইলি সেটেলার মুভমেন্ট সিন্স ১৯৬৭’ বইয়ের লেখিকা তিনি। উপরের লেখাটি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ।]
অনুবাদ করেছেন নাজমুল আহসান