লন্ডনে আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে আমরাই সম্মানীত করেছিলাম
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৪৪:২৭,অপরাহ্ন ২১ মে ২০২৩ | সংবাদটি ১১৮৪ বার পঠিত
আমার খুবই জানতে ইচ্ছে করে পরকালে কেমন আছেন অমর একুশের “আমার ভায়ের রক্তে রাঞ্জানো“ গানের রচিয়তা কিংবদন্তী সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী? সেটি কি জানা সম্ভব? সম্ভব না। মরনের পর কেউ কারো খবর জানতে পারেনা। একমাত্র সৃষ্টি-কর্তাই জানেন। গাফফার ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল লন্ডনে। আমি তখন লন্ডনের অন্যতম সবচাইতে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল-চ্যানেল আই ইউরোপের ষ্টাফ রিপোর্টার। উত্তপ্ত যৌবন আমার, বয়স কত হবে ২০/২১, একদিন কাজের খোঁজে গিয়েছিলাম চ্যানেল আই ইউরোপের পূর্ব লন্ডনের পপলারের অফিসে।
বিরাট অফিস। পুরো একটি বিল্ডিং। আমি একজনকে বলেছিলাম বসের সাথে দেখা করতে চাই (পরে জানলাম তার নাম সায়েরা বেগম লাকী, আমি তাকে লাকী ম্যাডাম বলেই ডাকতাম, তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের চোখে দেখতেন)। তিনি নিয়ে গেলেন বসের রুমে। আমার ধারনা ছিল যেহেতু চ্যানেল আই, সেহেতু এটির মালিক হবেন ফরিদুর রেজা সাগর স্যার, অথবা শাইখ সিরাজ স্যার। কিন্তু না যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তিনি রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েব। চ্যানেল আই ইউরোপের মালিক। সুঠাম দেহের অধিকারী। আমি প্রথম দেখায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি টেলিফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন, আমাকে ঈশারা করলেন বসতে, আমি বসলাম, টেলিফোন রেখে আমার নাম জিজ্ঞাস করলেন, বললেন কি চাই, বললাম স্যার একটি চাকুরী চাই। সব শুনে বললেন কিসে কাজ করতে চাও, বলেছিলাম নিউজে। কথাবার্তা ফাইনাল হলো, বললেন আগামী সপ্তাহে জয়েন করো। শুরু হলো লন্ডনে আমার টিভি সাংবাদিকতা, সেটি ২০১০ সাল। সারাক্ষন ক্যামেরা নিয়ে লন্ডনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে ঘুরে রিপোর্ট করাই ছিল আমার কাজ। ওয়েস্ট মিনিষ্টারের হাউস অব পার্লামেন্টে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের রিপোর্ট, লর্ড এভবেরীর রিপোর্ট, রুশনারা আলী, এ্যান ম্যান, টিউলিপ সিদ্দিকী থেকে শুরু করে সিলেট সমিতি- চিটাগাং সমিতি- ইষ্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যমলেটস কাউন্সিলের লেবার পার্টি -কনজারভেটিব পার্টি, ক্যামডেন কাউন্সিল এমনকি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানের নিউজও আমি করেছি। সেই সাথে থাকতো যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ-বিএনপি। যেহেতু আমি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম সেহেতু আওয়ামীলীগের নিউজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতাম। একদিন রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী স্যার ঠাট্রা করে বলেছিলেন মুরাদ তুমি তো চ্যানেলটা কে আওয়ামীলীগের বাক্স বানিয়ে ফেলেছ ! উল্লেখ্য, তখন বাংলাদেশের যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার পক্ষে ৯৫ ভাগ সংবাদ করেছিলাম আমি আর প্রচার হয়েছিলো চ্যানেল আই ইউরোপ ও চ্যানেল আই বাংলাদেশে।
সে যাক, খুব সম্ভবত ২০১১ সাল। সন্ধ্যায় অফিসে বসে বসে কাজ করছিলাম, রাতে নিউজ যাবে। হঠাৎ আলী ভাই, (চ্যানেল আই ইউরোপের লন্ডন অফিসের অফিস সহকারী) এসে বললেন সবাইকে বস ডাকছেন। গেলাম, একে একে তানভীর ভাই (বর্তমানে একাত্তর টিভির লন্ডন প্রতিনিধি), শুভ ভাই, বাহার ভাই, লাকী ম্যাডাম, ফরহাদ ভাই, রাজীব ভাই, মাহবুব ভাই, জামান ভাই, চয়ন আরো অনেকেই বসে আছেন। জিজ্ঞাস করেছিলাম স্যার কি ডাকছেন? বললেন হ্যাঁ, বললেন আব্দুল গাফফার চৌধুরীর নাম শুনেছ? সবাই বলেছিলো জ্বি শুনেছি, বলেছিলেন গাফফার ভাই লন্ডনে আছেন দীর্ঘদিন থেকে কোনো টেলিভিশন তাকে সম্মান জানায়নি। তার জন্মদিন নীরবে আসে নীরবে চলে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি গাফফার ভাইয়ের জন্মদিন আমরা লাইভ সম্প্রচার করবো আমাদের স্টুডিওতে। সবাই রাজী হলেন, যেই কথা সেই কাজ। ঘটা করে গাফফার ভাইর জন্মদিন পালন হরা হলো।
কমিউনিটির অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামীপন্থীরা বেশী আসলেন। জন্মদিনের ফুলের শুভেচ্ছায় শিক্ত হয়েছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। তাকে টেক্সি পাঠিয়ে বাসা থেকে নিয়ে আসা হতো চ্যানেল আই ইউরোপের লন্ডন অফিসে এবং গভীর রাতে আমি চ্যানেল আইয়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা এবং রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরীর বিশাল বড় গাড়ী রেনজ রোভার দিয়ে গাফফার ভাইকে বাসায় পৌছে দেওয়া হতো। এভাবেই ঘটা করে গাফফার ভাইর জন্মদিন পালন করতাম আমরা। দু্’ এক বার জামাল আহমদ খান ভাইও তাকে নিয়ে এসেছিলেন। লন্ডনের অনেকগুলো বাংলা টিভি চ্যানেল রয়েছে কিন্তু গাফফার ভাই্য়ের জন্মদিন লাইভ সম্প্রচার একমাত্র আমরাই করেছিলাম। এ রকম কয়েক বছর গাফফার ভাইয়ের জন্মদিন পালন করেছিল চ্যানেল আই ইউরোপ। আমি লন্ডন ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসার পরও সেটি অব্যাহত ছিল।
একদিন, বস গাড়ীতে করে গাফফার ভাইকে নামিয়ে দিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন, আমি ছিলাম গাড়ীতে। কথা প্রসংঙ্গে গাফফার ভাই বলেছিলেন, ফয়সল এ টেলিভিশন কি করে তুমি চালাও। অনেক ব্যয় বহুল। তোমার কোনো কাজ থাকলে আমাকে বলো বাংলাদেশে কোনো কিছু করলে আমাকে বলবা আমি সরকারের কাছ থেকে তোমার কাজ করে দিব। এছাড়া, রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরীকে অনেক মাননীয় মন্ত্রী- এমপিও অনেক কাজের অফার করেছেন কিন্তু তিনি করেননি। অথচ বাংলাদেশে দেখেছি আওয়ামীলীগের নাম করে কত কিছু মানুষ বাগিয়ে নিয়ে পয়সা কামাই করেছে। গাফফার ভাইয়ের কাছ থেকে অনেকেই সুযোগ সুবিধে নিয়েছেন, কিন্তু রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েব কথনো কোনো সুবিধার জন্য গাফফার ভাইর কাছে যাননি, এমন কি কোনো মাননীয় মন্ত্রী-এমপির কাছেও যাননি।
সেদিন এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েবের সাথে। তিনি দুঃখ করে বললেন বাংলাদেশের এক শ্রেণীর গনমাধ্যম এবং গুটি কয়েক কর্মকর্তা ও আওয়ামীলীগের কিছু সুবিধা ভোগী নেতারা তাকে রাজাকারের সহযোগী এবং তারেক জিয়ার পেইড এজেন্ট বানানোর অপচেষ্টা করেছে। আমাকে বললেন মুরাদ ওরা এতটাই নীচু মন-মানসিকতার অধিকারী যে আমাকে পেইড এজেন্ট আখ্যা দেয়। আমি লন্ডনে টিভি চ্যানেলের মালিক হলাম ২০০৭ সাল থেকে, আমাকে নিয়ে লিখে আমি নাকি চ্যানেল আইয়ে কাজ করেছি। তিনি আরো বললেন, কর্নেল ফারুকের ছেলে যখন লন্ডনে প্রেস কনফারেন্স করেছিল তখন আমি রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরীই সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম। তখন কোথায় ছিলো এত বড় বড় আওয়ামীলীগের নেতারা অথবা আওয়ামী লীগের বড় বড় সাংবাদিকরা, সেদিন তো কেউ প্রতিবাদ করেননি। কর্নেল ফারুকের ছেলে তো ইষ্ট লন্ডনেই প্রেস কনফারেন্স করেছিল!
প্রিয় পাঠক, আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে আমি লিখতে পারবনা, লেখার মত হয়ত যোগ্যতাই হয় নি। তবে, যা লিখেছি সব কিছুরই আমি চাক্ষুস স্বাক্ষী ছিলাম। গাফফার ভাই অনেককেই বলেছিলেন, তাকে জীবদ্দশায় সম্মানীত করেছে চ্যানেল আই ইউরোপের ব্যবস্থাপনার পরিচালক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী এবং তার টিম। গাফফার ভাইয়ের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে দাড়িয়ে অনেক কিছুই মনে পড়ছে।
শেষ কথাঃ গাফফার ভাইয়ের জন্মদিন আমরা যখন পালন করতাম তখন একটি পোষ্টারে গাফফার ভাইয়ের ছবি থাকতো এবং লেখা থাকতো “যতদিন বেঁচে আছো মুক্ত হয়ে বাঁচো, আকাশে ও মাটির কন্ঠে শুনি যেন তুমি বেঁচে আছো’। গাফফার ভাই বেঁচে আছেন বাংলার আকাশে বাতাসে, তিনি বেঁচে আছেন বাঙালীর নিঃম্বাসে এবং বিশ্বাসে। গাফফার ভাইয়ের মৃত্যু নেই।
এম আর মুরাদ
সাবেক বার্তা সম্পাদক চ্যানেল আই ইউরোপ
২০/০৫/২০২৩ ইংরেজী
ঢাকা, বাংলাদেশ।