নির্বাচন কি ব্যাপক গাম্ভীর্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠান? পর্যবেক্ষকরা তাহলে কী করবেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৫০:৫২,অপরাহ্ন ২১ নভেম্বর ২০১৮ | সংবাদটি ৯৮০ বার পঠিত
ভদ্রলোক খুব ফুরফুরে মেজাজে কথা বলছিলেন। মাত্র কিছু দিন পর নির্বাচন। আমাদের মত দেশে সব কিছু কাংখিত মতে কাজ করলেও নির্বাচন কমিশনের উপর নির্বাচন বলতে যা বুঝায়- একটা সুষ্ঠু, অবাধ সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার কত না ঝক্কি ঝামেলা। এমনকী অতীতে সামরিক শাসনামলে বা দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময়ও কমিশনের লোকজনের একটা বাডতি ব্যস্ততা, নিজেদের মত করে মানুষের কাছে প্রচারণা লক্ষ্য করা যেত। যদিও এসব নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। এবার সব কিছুই কেমন যেন ব্যতিক্রম। ভদ্রলোক ইসি সচিব হেলালুদ্দিন। খুব আত্নবিশ্বাসের সুরে যেন মজা করেই বলছিলেন ব্রিটেনের মূর্তির মত দাডিয়ে থাকা কিছু পুলিশের কথা। ঠিক তাদের মত করেই নির্বাচন পর্যবেক্ষককে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বড্ডো অদ্ভূত শোনা গেল উনার নির্দেশনা। কেন্দ্র্ প্রিসাইডিং অফিসার আর পুলিশের দায়িত্বর্প্রাপ্ত কর্মকর্তা এ দুজন ছাডা কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। পর্যবেক্ষক কোন ছবি তুলতে পারবেন না। সাক্ষাৎকার ( ভদ্রলোকের ভাষায় সারা দেশে টিভিতে ছবি দেখানো) নিতে কিংবা দিতে পারবেন না। নির্বাচন পর্যবেক্ষক ‘মূর্তির’ মত দাডিয়ে থেকে যা দেখবেন তা নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন। কেউ ভদ্রলোককে প্রশ্ন করেনি – মূর্তির মত নিশ্চল দাডিয়ে থাকলে তিনি তার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন বা নির্বাচন কমিশনকে জানানোর জন্য ন্যূনতম তথ্য, তার দেখা কোন পরিস্থিতির বর্ণনার জন্য তথ্য কিভাবে পাবেন বা সংগ্রহ করবেন।
কোন মিডিয়ার সাথে নির্বাচন নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ইসির ভাষায় ‘ নির্বাচন বিরোধী’ বিরূপ মন্তব্য বা কথা বলতে পারবেন না। ছবি তুলতে পারবেন না, গোপন কক্ষে যেতে পারবেন না ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। তাহলে পর্যবেক্ষক কি করবেন? তথ্য প্রমাণ ছাডা তিনি কিভাবে প্রতিবেদন করবেন? নির্বাচন কি নাট্য মঞ্চের নাটক কিংবা ব্যাপক ধর্মীয় গাম্ভীর্যের আশুরা অনুষ্ঠান?
৯০ এর পর দলীয় সরকারের অধীনে তৃতীয়বারের মত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনের পর এবারও সুবিধাভোগী অনেকের আশা ছিল মনোনয়ন দল থেকে ফেলেই বুঝি কেল্লা ফতে। ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্য ফ্রন্ট গঠিত হবার পর সব হিসেবে কিতেব পাল্টে যেতে থাকে। কারো কারো মতে নির্বাচন যেমনই হোক ২০১৪ এর মত আর কারোরই পার পেয়ে যাবার উপায় থাকলো না, এটা নিশ্চিত। তবে এরি মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এসব সংশয় অবসান এবং একটি সুষ্ঠু অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে অংগীকারাবদ্ধ এবং সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা সফলভাবে ব্যবহার করার সক্ষমতা দেখাতে হবে। সংবিধান অনুসারে তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে গেছে। প্রচলিত আইন সংবিধান ও রীতি অনুসারে এখন নির্বাচন কমিশন তার কাজের মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, আচরণবিধি লংঘনের দিকে দৃষ্টি রাখা, সম্ভাব্য লংঘনে তাৎক্ষণিক দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো, প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসব দরকারী কাজ ফেলে অবান্তর নীতিমালার কথা বলে যেন তেন ভাবে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্ক্রীপ্টের মধ্যেই কমিশন যেন কাজ করে চলেছে। নির্বাচন কমিশনের সচিব রাস্ট্রীয় রীতি ও উৎসবে সুসজ্জিত পুলিশ ও রয়েল গার্ডদের মত মূর্তিসম দাডিয়ে পর্যবেক্ষণের যে সবক দিলেন তা হাস্যকর হলেও কারো কারো ধারণা, এর মধ্য দিয়ে আসলে কমিশনের ইচ্ছেরই প্রতিফলন ঘটেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, মূল মিডিয়াতে লাইভ করা যাবে না। ফোন থাকবে না। সবার রিপোর্ট এক করা ছাডা মন্তব্য করা যাবে না! উদ্ভট এ সব বিধিবিধানে মনে হয় নির্বাচন কমিশন কী ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে কোন অনুষ্ঠান না কোন পাতানো নির্বাচন করার আযোজনে আছে! কমিশনের সাথে সংলাপে ৪০ দলের মধ্যে ৩৫ দল ইভিএম ব্যবহারে সমর্থন না দিলেও ইভিএম নিয়ে সিইসি বেশ তৎপর; ইভিএম অপারেট করার মত প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট থাকলেও অন্তত: একশটি আসনের কিছু কেন্দ্রে ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ১৬ টি হাই স্কুল সরকারীকরণের গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে। মোহাম্মদপুরে সরকার দলীয় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে দুই জন নিহত হবার মামলার আসামী দ্রুত জামিন পেয়ে গেছে। অন্যদিকে নয়াপল্টনের ঘটনায় পুলিশ বেশ তৎপর। স্কাইপে বন্ধ করা হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডন থেকে স্কাইপের মাধ্যমে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এটা চাউর হয়ে যাবার পর। খুলনায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিষয়ে পুলিশের তথ্য সংগ্রহের প্রমাণ পাওয়া গেছে, একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন-এ ব্যাপারে পুলিশ নির্বাচন কমিশনের কোন অনুমতি নেয় নি। কিন্তু এরকম বিষয়গুলোতে কমিশনের কোন ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়! শেষ পর্যন্ত কি হয় তার জন্য আপাতত অপেক্ষা করা ছাডা বিকল্প নেই। তবে প্রভাত যদি দিনের ইংগিত হয় তাহলে বুঝতে হবে নির্বাচনকে ঘিরে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশ। সব পক্ষের সদিচ্ছা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই সম্ভব, যা অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর আমলে কম বেশি হয়েছে। সে রকম না হোক অন্তত সাধারণভাবে জনমতের প্রতিফলন কি এ নির্বাচনে হবে ? সাধারণভাবে আশাটা বেশি না রাখাই বোধহয় সংঘত। নানা গল্প কল্প প্ল্যান এ বি’র কথা বাংলার আকাশে বাতাসে উডছে। সাতসমুদ্দর তের নদীর দূরত্বে থেকে সে সবের কিছু হাওয়া এ মুহূর্তের শীতল উষ্ণতার লন্ডনেও টের পাচ্ছি।
-শাহ আলম ফারুক
আইনজীবি, মানবাধিকার কর্মী
সাবেক সিনিয়র তদন্ত কর্মকর্তা
আইন ও সালিশ কেন্দ্র আসক
faruk69@gmail.com